মার্কিন মুলুকে ভোট আগামী ৫ নভেম্বর। মার্কিন ভোটের প্রচার সরগরম ট্রাম্প-মাস্ক-পুতিন অক্ষ নিয়ে। যদি ট্রাম্প জেতেন, সুবিধা ভারতের? লিখলেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
নভেম্বরের প্রথম সোমবারের পরের দিন, মঙ্গলবার আমেরিকায় ভোটগ্রহণ। অর্থাৎ ৫ তারিখ। ৫ নভেম্বর মার্কিন মুলুকে ভোটের দিন হলেও, ৪৭টি রাজে্য অনেক অাগেই ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে গিয়েছে। ওদের দেশে এটাকে বলে ‘আর্লি ভোট’। কয়েকটি নির্দিষ্ট সরকারি দপ্তরে ভোটের দিনের অাগেই হাজির হয়ে যে কেউ তাঁর ভোটটি দিয়ে আসতে পারেন। এবারও অামেরিকায় ইতিমধ্যে লক্ষ লক্ষ ভোটদাতা ‘আর্লি ভোট’ দিয়ে দিয়েছেন। লক্ষ লক্ষ মানুষের ভোটদান হয়ে যাওয়ার পরে যে সর্বশেষ জনমত সমীক্ষা প্রকাশে্য এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে একেবারে কঁাটায়-কঁাটায় রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ডেমোক্র্যাট দলের কমলা হ্যারিস। অর্থাৎ যে কেউ জিততে পারেন। কয়েক দিন অাগেই চিত্রটা অন্যরকম ছিল। হ্যারিস সামান্য হলেও এগিয়ে ছিলেন।
মার্কিন মুলুকে ভোটের জনমত সমীক্ষা অামাদের এখানকার ‘একজিট পোলে’-র মতো নয়। ‘একজিট পোল’-এর ক্ষেত্রে অামাদের অভিজ্ঞতা হল যে, অধিকাংশ সময়েই এটা বাস্তবের অনেক দূরে অবস্থান করে। অামেরিকায় জনমত সমীক্ষা না মেলাই ব্যতিক্রমী ঘটনা। ফলে ভোটদান শেষ হওয়ার অাগেই স্পষ্ট হয়ে যায় ফল। সর্বশেষ সমীক্ষায় ট্রাম্প ও হ্যারিস একই বিন্দুতে দঁাড়িয়ে বলে অাবার এটাও নয় যে, ম্যাচ টাই হয়ে যাবে। ৫ নভেম্বরের অাগে শেষ একসপ্তাহে যে কেউ অনেকটা এগিয়ে যেতে পারেন। অামেরিকার ভোটে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণ করে সুইং স্টেটগুলি। এটাও সে-দেশের ভোটের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
৫০টি রাজে্যর মধে্য অধিকাংশ ভোটের বহু অাগে থেকেই সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়ে নেয় যে, কোন দলকে জেতাবে। যেমন পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলের অধিকাংশ রাজ্য ঐতিহাসিকভাবে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীদের জেতায়। উপকূলের রাজে্যর মধে্য নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি, ক্যালিফোর্নিয়া ইত্যাদি পড়ে। এইসব উপকূলের রাজে্য কৃষ্ণাঙ্গ ও অভিবাসীদের সংখ্যা বেশি। এরা যুগ যুগ ধরে ডেমোক্র্যাটদের সমর্থক। মধ্য অামেরিকার শ্বেতাঙ্গ অধু্যষিত কৃষিপ্রধান রাজ্যগুলি অাবার রিপাবলিকানদের ঘঁাটি। রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের দিকে ঝুঁকে থাকা রাজে্যর বাইরে প্রতিবারই থাকে কিছু ‘সুইং স্টেট’। এই রাজ্যগুলিতে যে কোনও দলই জিততে পারে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দু’-দলের টানাপোড়েন চলে এইসব রাজে্য। এবার যেমন সাতটি রাজ্য চিহ্নিত হয়েছে ‘সুইং স্টেট’ হিসাবে। দুই প্রার্থী পড়ে রয়েছেন এই সাতটি রাজে্য। এই সাতটি রাজে্যর ভোটার ঠিক করে দেবেন প্রেসিডেন্টের কুর্সি কার দখলে যাবে।
মার্কিন ভোটের সর্বশেষ সমীক্ষার ফল দেখে কিছুটা স্বস্তির হাওয়া বওয়া উচিত নয়াদিল্লির সাউথ ব্লকে। কমলা হ্যারিসের ভারত-যোগ যতই নিবিড় হোক, দিল্লির প্রথম পছন্দে যে ডোনাল্ড ট্রাম্প, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্কের রসায়ন নিয়ে নতুন করে কিছু বলতে যাওয়া বাহুল্য হবে। ২০১৯ সালে টেক্সাসে গিয়ে সরাসরি ট্রাম্পের প্রচারে নেমে পড়েছিলেন মোদি। যা ছিল এক বেনজির ঘটনা। মার্কিন ভোটাররা অবশ্য সে-বছর মোদিকে হতাশ করেছিলেন। এবার হয়তো মোদি অাশায় বুক বঁাধছেন। যদিও জো বাইডেনের চার বছরে ভারত-মার্কিন সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে এ-কথা বলার কোনও জায়গা নেই। তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে দু’-দেশের সহযোগিতা বেড়েছে। বিশেষত সেমিকন্ডাক্টর চিপ নির্মাণ শিল্পে বাইডেন প্রশাসন যেভাবে ভারতের দিকে সাহাযে্যর হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, তা উল্লেখের দাবি রাখে। কোয়াডের শেষ বৈঠকে বাইডেন কলকাতায় মার্কিন প্রযুক্তি দিয়ে সেমিকন্ডাক্টর কারখানা করার কথা ঘোষণা করেছেন। ট্রাম্প এক্ষেত্রে তুখড় ব্যবসায়ী। বিনা মূলে্য প্রযুক্তি দিতে তঁার ঘোর অনীহা।
কিন্তু মোদি সরকার তাকিয়ে ট্রাম্পের কট্টর চিন-বিরোধী অবস্থানের দিকে। ট্রাম্প প্রশাসনের অগ্রাধিকারের তালিকায় ভারত সবসময়ই পাকিস্তানের অাগে থাকবে বলে ধরে নিতে হবে। ট্রাম্পের পাকিস্তানের প্রতি কিছুটা বিরূপ মনোভাব বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে উপমহাদেশের রাজনীতিতে ভারতের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্প-পুতিন সখ্যও ভারত ইতাবাচক চোখে দেখে। দু’-একদিন অাগে মার্কিন সংবাদমাধ্যমে ধনকুবের ইলন মাস্কের সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ নিয়ে খবর ফঁাস হয়েছে। স্পেসএক্স ও এক্স হ্যান্ডলের মালিক মাস্ক এবার প্রকাশে্য ট্রাম্পের হয়ে প্রচারে নেমেছেন। মার্কিন ভোটের প্রচার সরগরম ট্রাম্প-মাস্ক-পুতিন অক্ষ নিয়ে। তিন মাসের মধে্য দু’বার রাশিয়া সফর করে বাইডেন প্রশাসনের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করে মোদিও পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছেন। ট্রাম্প মার্কিন প্রশাসনের মাথায় বসলে যে মোদি-পুতিনের সম্পর্কের মসৃণতা বাড়বে, তা নিয়ে সংশয় নেই কূটনৈতিক মহলের। যেটা রক্তচাপ বাড়াতে পারে বেজিংয়ের।
সব মিলিয়ে মোদির অামলের সাউথ ব্লক ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে পদক্ষেপে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ। মা ভারতীয় বলে কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট হয়ে ভারতের দিকে ঝুঁকবেন, এমনটা মনে করছে না সাউথ ব্লকও। বরং নিজের নিরপেক্ষতা বোঝাতে হ্যারিস ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তঁার দলের পূর্বসূরিদের টানা গণ্ডির মধে্যই নিজেকে অাটকে রাখার চেষ্টা করবেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে বসেও হ্যারিস কোনও দুর্বলতা দেখাননি মোদি প্রশাসনের উপর। মানবাধিকার লঙ্ঘন, ধর্মীয় স্বাধীনতা ইত্যাদি কিছু প্রশ্নে হ্যারিস একাধিকবার মোদি প্রশাসনের সমালোচনাও করেছেন, যা কখনওই সাউথ ব্লক ভাল চোখে দেখেনি। যদিও বাণিজ্য মহলের উদ্বেগ রয়েছে ট্রাম্পের ‘অামেরিকা ফার্স্ট’ নীতি ও বৈদেশিক বাণিজে্য বরাবর রক্ষণশীল অবস্থান গ্রহণের নীতি নিয়ে। হার্লে ডেভিডসন বাইকে ভারত কেন ১৫০ শতাংশ শুল্ক বসাবে, তা নিয়ে শোরগোল ফেলেছিলেন ট্রাম্প। ভারতকে শুল্ক বসানোর রাজা বলেও অাখ্যা দিয়েছেন। সাউথ ব্লক ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতি নিয়ে অতটা ভাবিত নয়। সাম্প্রতিক ভূরাজনীতির বিচার করে হোয়াইট হাউসে তারা ট্রাম্পের মতো পরিক্ষিত একজন বন্ধুকেই চাইবে।