বিগত কয়েক দশকে অতি দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রনেতাদের উত্থানে বদলে যাচ্ছে বৈশ্বিক কূটনীতি। ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলির সম্পর্কের পট পরিবর্তন হয়েছে। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, নেপালের মতো একাধিক দেশে গণবিক্ষোভে শাসনতন্ত্রে পরিবর্তন হয়েছে। এমনকী দিল্লির প্রতি বিদ্বেষের মনোভাব দেখা যাচ্ছে। মজার হল 'যাদের জন্য করি চুরি তারাই বলে চোর' প্রবাদবাক্য প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। শুরুতে বন্ধু থেকে 'ভারতশত্রু' বনে যাওয়া মালদ্বীপ, তুরস্কেরও উদাহরণ টানা যায়। লিখছেন চন্দ্র গুপ্ত।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কা। ঘূর্ণিঝড় দিতওয়ার তাণ্ডবে লন্ডভন্ড দেশটি। ইতিমধ্যেই দ্বীপরাষ্ট্রের ঘূর্ণিঝড় প্রাণ কেড়েছে ৬৯ জনের। প্রতিবেশী দেশটির সংকটে পাশে দাঁড়াতে ‘অপারেশন সাগর বন্ধু’ শুরু করেছে ভারত। ইতিমধ্যে ত্রাণসামগ্রী পাঠানো শুরু হয়েছে। পাশাপাশি সবরকম সাহায্যের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, ভারতের 'বন্ধুত্বে'র দাম দেবে দ্বীপরাষ্ট্রে? নাকি অতীতের মতোই ফের নয়দিল্লির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে চিনা ফাঁদে পা দেবে তারা?
বিগত কয়েক দশকে অতি দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রনেতাদের উত্থানে বদলে যাচ্ছে বৈশ্বিক কূটনীতি। ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলির সম্পর্কের পট পরিবর্তন হয়েছে। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, নেপালের মতো একাধিক দেশে গণবিক্ষোভে শাসনতন্ত্রে পরিবর্তন হয়েছে। এমনকী দিল্লির প্রতি বিদ্বেষের মনোভাব দেখা যাচ্ছে। মজার হল 'যাদের জন্য করি চুরি তারাই বলে চোর' প্রবাদবাক্য প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। শুরুতে বন্ধু থেকে 'ভারতশত্রু' বনে যাওয়া তুরস্কের উদাহরণ টানা যায়।
এই সেদিনের কথা, ২০২৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ৭.৮ মাত্রার ভয়ংকর ভূমিকম্প তছনছ হয়ে যায় তুরস্ক ও সিরিয়া। উভয় দেশ মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা ৬০ হাজার ছাড়ায়। কেবল তুরস্কে মৃতের সংখ্যা ছিল ৫০ হাজারের বেশি। বরাবর মানবিক রাষ্ট্রনীতি ভারতের। দেরি না করে 'অপারেশন দোস্ত' ঘোষণা করে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকার। শুধু বিপুল পরিমাণ ত্রাণ পাঠিয়ে কর্তব্যে ইতি টানেনি দিল্লি, পাশাপাশি উদ্ধাকারী দল পাঠানো হয় সিরিয়ার ভূমিকম্প বিধ্বস্ত এলাকাগুলিতে। বন্ধুত্বের এই ঋণ কীভাবে মেটাল তুরস্ক?
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলা সামরিক সংঘাতে ‘গদ্দারি’ করে তুরস্ক। ভারতে হামলা চালাতে শুধু ড্রোন দিয়ে সাহায্য নয়, পাকিস্তানে সেনাও পাঠিয়েছিল তারা। এখানেই শেষ নয়, কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ায় তারা। রাষ্ট্রসংঘে সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে ইসলামাবাদের পাশে দাঁড়ায়। 'সিঁদুর' আবহে এহেন দু’মুখো সাপ তুরস্কের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপের দাবি ওঠে দেশজুড়ে। তুর্কি বিমানবন্দর ব্যবস্থাপনার সংস্থা সেলেবি অ্যাভিয়েশন ভারতে কাজ করা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সেদেশে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করেন ভারতীয় পর্যটকরা। নেটদুনিয়ায় ট্রেন্ডিং হয় বয়কট তুরস্ক। মোদ্দা কথা, বন্ধুত্বের বদলা কৃতঘ্ন আচরণ করে দেশটি।
উপকারী ভারতকে বিপদে ফেলেছে মালদ্বীপও। অথচ ভারত ও মালদ্বীপের মধ্যে কৌশলগত, অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ১৯৬৫ সালে মালদ্বীপের স্বাধীনতা লাভের পর ভারতই প্রথম দেশ হিসেবে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। সামগ্রিক উন্নয়নে এবং বিপদে বারবার দেশটির পাশে দাঁড়িয়েছে নয়াদিল্লি। এত কিছুর পরে ২০২৩ সালের নভেম্বরে মাসে মহম্মদ মুইজ্জু রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর 'ইন্ডিয়া আউট' নীতি শুরু করে মালদ্বীপ। আচমকাই ভারতকে দূরে ঠেলে চিনকে 'বড়দা' বানায় তারা। এই সুযোগ কাজে লাগায় বেজিং। ভারত মহাসাগরে কৌশলগত সুবিধা নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। যদিও সম্প্রতি বোধদয় হয়েছে মালের। দ্বীপরাষ্ট্রের আগ্রহে স্বাস্থ্য ক্ষেত্র, মৎস্য উৎপাদন, ডিজিটাল পরিকাঠামো-সহ ছয়টি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে দিল্লি-মালে।
বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে খোদ শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধেও। ২০২২ সালের মাঝামাঝি অর্থনৈতিক সঙ্কটের ছোবলে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল পড়শি দেশ। দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশ ছুঁয়েছিল। দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোগাড় করাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রবল গণবিক্ষোভের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। পড়শি দেশের এই বিপদের দিনে দেবদূতের মতো পাশে দাঁড়িয়েছিল ভারত। মোট ৪০০ কোটি ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা) অর্থসাহায্য গিয়েছিল দিল্লি। সেকথা ভুলে চিনা নজরদারি জাহাজকে দ্বীপরাষ্ট্রের উপকূলে ঠাঁই দিয়েছিল শ্রীলঙ্কার নতুন সরকার। ভারতের আপত্তি উড়িয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা।
মানবিক ভারত অবশ্য অতীতের অসৌজন্য উপেক্ষা করে প্রতিবেশী দেশের সংকটে পাশে দাঁড়িয়েছে আবারও। ঘূর্ণিঝড় দিতওয়ার তাণ্ডবে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কার সাহায্য করতেই ‘অপারেশন সাগর বন্ধু’ শুরু করেছে নয়াদিল্লি। প্রশ্ন হল, ভবিষ্য়তে পালটা তিক্ত অভিজ্ঞতা হবে না তো? যেমনটা হয়েছে বাংলাদশের ক্ষেত্রে। কোভিডের সময় ঢাকাকে অকাতরে টিকা বিলিয়েছিল যে ভারত, সেই দেশটিকেই এখন প্রধান শত্রু বানিয়ে ফেলেছে মহম্মদ ইউনুসের অন্তরবর্তী সরকার। 'উপকারীকে বাঘে খায়', এই প্রবাদকে মান্যতা দিতে বদ্ধপরিকর তুরস্ক, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, বাংলাদেশ, নেপালের মতো দেশগুলি।
