দেশের অর্ধেক সম্পদ যদি মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে চলে যায়, সেখানে ট্রাম্পের দাবি মতো ভারতীয় অর্থনীতি ‘মৃত’ না হলেও ‘উন্নত’ নয়। বিভিন্ন উন্নত দেশে যেভাবে বৈষম্য নিয়ন্ত্রণ করা হয়, সামাজিক সুরক্ষা দেওয়া হয়, ভারতের ক্ষেত্রে তা অপ্রতুল।
সম্প্রতি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত সম্পর্কে একটি বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন। ভারতের অর্থনীতিকে ‘ডেড ইকোনমি’ বলে দাবি করেছেন। এই মন্তব্য শুধু রাজনৈতিক মহলেই নয়, অর্থনীতিবিদদের মধ্যেও ঝড় তুলেছে। প্রশ্ন উঠেছে, ভারতের অর্থনীতি কি সত্যিই ‘মৃত’? যদিও নরেন্দ্র মোদি সরকারের দাবি, এই তথ্য ‘অসার’। ভারত এখন বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতি, এখনই শীর্ষ পঁাচে রয়েছে এবং দ্রুত তৃতীয় স্থানে পৌঁছে যাবে। এমনকী, আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের তথ্যও বলছে, ভারতের অর্থনীতি ১৯৯৫ সালের তুলনায় ইতিমধ্যেই ১২ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। চিন ও রাশিয়াকে বাদ দিলে ভারতই একমাত্র বড় অর্থনীতি, যার আকার আমেরিকার তুলনায় দ্রুতগতিতে বেড়েছে।
কিন্তু এটাও বাস্তব, মনমোহন সিং সরকারের আমলে গড় জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ৬.৮ শতাংশ, মোদি সরকারের আমলে (২০১৪-২০২২) গড় জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ৫.২৫ শতাংশ। পাশাপাশি, বিশ্ববাজারে ভারতীয় পণ্যের রফতানি মোট রফতানির মাত্র ১.৮%। স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় ভারত এখনও বিশ্বমানে পিছিয়ে।
‘উন্নয়ন’ এমন সামগ্রিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে দেশ, সমাজ বা ব্যক্তির অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত অবস্থার উন্নতি, জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি এবং মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও মুক্তি সম্প্রসারিত হয়। যেখানে দারিদ্র ও বৈষম্য হ্রাস পায় এবং একটি ইতিবাচক সামাজিক পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু ভারতের উন্নয়নের ছবিটা সে-কথা বলছে না। ২০২৪ সালেও ভারতের ২৪% মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করছে। আয় ও সম্পদের বৈষম্য আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। যার সাম্প্রতিক তথ্য ফুটে উঠেছে ‘এমথ্রিএম হুরুন ইন্ডিয়া’-র প্রকাশিত ভারতের সবচেয়ে বিত্তশালী নাগরিকদের তালিকায়। যেখানে দেখা গিয়েছে, সারা ভারতে যত সম্পদ রয়েছে, তার অর্ধেকের মালিক মাত্র ১৬৮৭ জন! এই বিত্তশালীদের মোট সম্পদের পরিমাণ ১৬৭ লক্ষ কোটি টাকা, যা ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি-র প্রায় অর্ধেক।
অন্যদিকে, বৈশ্বিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংস্থা ‘বার্নস্টেইন’ তাদের রিপোর্টে জানিয়েছে, দেশের শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর কাছে রয়েছে মোট সম্পদের প্রায় ৫৯ শতাংশ। এই ছবিটাই আর্থিক বৈষম্যের হাল স্পষ্ট করছে। যদি দেশের অর্ধেক সম্পদ মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে চলে যায়, তাহলে অর্থনীতির জন্য সমস্যা তো বটেই, গণতন্ত্রের পক্ষেও সুখকর নয়। একদিকে, কয়েকজন অপরিমেয় সুবিধা, বিলাসের অধিকারী। অন্যদিকে, কোটি কোটি ভারতীয় দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। কমছে আয়ের সুযোগ, বাড়ছে মূল্যবৃদ্ধি। বিপন্ন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলিও। ট্রাম্পের দাবি মতো ভারতীয় অর্থনীতি ‘মৃত’ না হলেও তা আদৌ ‘উন্নত’ নয়। বিভিন্ন উন্নত দেশে যেভাবে বৈষম্য নিয়ন্ত্রণ করা হয়, সামাজিক সুরক্ষা দেওয়া হয়, ভারতের ক্ষেত্রে তা অপ্রতুল। মোদি সরকারের এই উন্নয়ন দেশের ও সমাজের পক্ষে আদৌ সহায়ক নয়।
