shono
Advertisement

‘রামরাজ্য’ সংকটের সুরাহা?

রামমন্দির উদ্বোধন মোদির নির্বাচনী প্রচারেরও সূচনা।
Posted: 02:46 PM Jan 23, 2024Updated: 05:38 PM Jan 27, 2024

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে ‘রামরাজ‌্য’ প্রতিষ্ঠার কথা শোনালেন, তা আসলে হিন্দু রাষ্ট্রর ভাবনা থেকেই উৎসারিত। একইসঙ্গে তা মোদির নির্বাচনী প্রচারেরও সূচনা করেছে। হিন্দু রাষ্ট্র ও রামের মধ্যেই সব সমস‌্যার সমাধান খোঁজার এই বিপজ্জনক প্রবণতা দেশকে শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যাবে? লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী

Advertisement

সমাজতাত্ত্বিকরা বলে থাকেন, গান্ধীজি রাজনীতির জটিল ধারণাগুলি মানুষকে সহজভাবে বোঝানোর জন‌্য প্রতীকের ব‌্যবহার করতেন। সেই প্রতীক হিসাবেই গান্ধীজির কণ্ঠে ‘রামরাজ‌্য’ এসেছিল। ‘রামরাজ‌্য’ বলতে গান্ধীজি আদর্শ রাষ্ট্রের বার্তা দিতেন। ব্রিটিশ রাজত্বকে তিনি ‘রাবণ রাজ’ বলে অভিহিত করতেন। গান্ধীজির ‘রামরাজ‌্য’-য় কোনও ধর্মীয় দ্যোতনা ছিল না। সাম্প্রদায়িক রং-ও নয়। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতেই ‘রামরাজ‌্য’ ও ‘রাবণ রাজ’ প্রসঙ্গ পাশাপাশি আসত গান্ধীজির ভাষণে। ‘রামরাজ‌্য’ বলতে তিনি বোঝাতেন ন‌্যায় ও আদর্শের উপর দাঁড়িয়ে থাকা একটি রাষ্ট্রের কথা। ‘রাবণ রাজ’ দিয়ে তিনি শয়তানের রাষ্ট্র বোঝাতেন। যা অসাম‌্য ও অন‌্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত।

রামমন্দির উদ্বোধনের পর অযোধ‌্যা থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে ‘রামরাজ‌্য’ প্রতিষ্ঠার কথা শোনালেন, তা যে হিন্দু রাষ্ট্রর ভাবনা থেকেই উৎসারিত, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। মোদি বা সংঘ পরিবারের হিন্দুত্বের ধারণা রামেই সীমাবদ্ধ। দশ বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসার পর থেকে সংঘর ‘অ‌্যাজেন্ডা’ রূপায়ণ করাই মোদির একমাত্র লক্ষ‌্য। মন্দির চত্বর থেকেই তাই মোদির ঘোষণা– ‘একটা লক্ষ‌্য সত্যি প্রমাণিত হয়ে গেলে এটাও প্রমাণিত হয় যে, আর এক লক্ষ্যে পৌঁছনো অসম্ভব নয়।’ পরবর্তী লক্ষ‌্য বলতে মোদি কীসের ইঙ্গিত করেছেন, তা অস্পষ্ট নয় কারও কাছেই। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা খর্ব করে সংবিধানের ৩৭০ ধারা লোপ পেয়েছে। নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন হয়েছে। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগুর পাইলট প্রকল্প শুরু হয়ে গিয়েছে। সর্বোপরি রামমন্দিরের উদ্বোধন হয়ে গেল। নির্বাচনী ইস্তেহারের সব ঘোষণাই রূপায়িত। এখন হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাটা যে আর কোনও অলীক কল্পনা নয়, মোদি এদিন সেই বার্তাটাই দিতে চেয়েছেন।

 

[আরও পডু়ন: ‘ভেবেচিন্তে কথা বলুন…’, রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠার দিনই কেন এমন কথা মিঠুনের মুখে?]

উদার ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রর পথ ছেড়ে ‘রামরাজ‌্য’ বা হিন্দু রাষ্ট্রর দিকে ভারতের যাত্রা অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে কতটা মঙ্গলজনক হবে, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে। জিডিপির নিরিখে ভারতের অর্থনীতি এখন বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম। চলতি অর্থবছরের শেষ ত্রৈমাসিকেও ভারতের সাত শতাংশের বেশি অার্থিক বৃদ্ধি ঘটেছে। গত কয়েক দশকে ভারতে যোগাযোগ ও পরিবহণ ব‌্যবস্থার বিপুল পরিকাঠামো গড়ে উঠেছে। ভারতের পুঁজির বাজার অত‌্যন্ত সমৃদ্ধ এবং ব‌্যাপ্ত। ভারতের কর কাঠামোর পর্যাপ্ত সরলীকরণ হয়েছে। একক বাজার হিসাবে ভারত গোটা বিশ্বের বণিকমহলের সামনে সবচেয়ে লোভনীয় গন্তব‌্য। ভারতে লগ্নি করলে উৎপাদকরা সংস্থা বড় করে খরচ কমানোর সুবিধাও সহজে উপভোগ করতে পারে। যা লগ্নি অাকর্ষণের অন‌্যতম পূর্বশর্ত।

কিন্তু এতসব সম্ভাবনা ও উজ্জ্বল ভবিষ‌্যতের হাতছানির মধ্যেও দেশ এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত। শিল্পের কাঙ্ক্ষিত প্রসারলাভ ঘটছে না। গত একদশকে দেশে উল্লেখ করার মতো শিল্প-লগ্নি নেই বললেই চলে। শিল্প-পণে‌্য গোটা বিশ্বের যে জোগান শৃঙ্খলা তার সঙ্গে ভারত পূর্ণমাত্রায় যুক্ত হতে পারছে না। অান্তর্জাতিক বাজারে এখনও পর্যন্ত খুব কম ভারতীয় ব্র‌্যান্ডই নিজের জায়গা করে নিতে পেরেছে। দক্ষ শ্রমিকের অভাবে বহুজাতিক সংস্থাগুলি ভারতে লগ্নির ক্ষেত্রে দ্বিধাগ্রস্ত। দেশের শিক্ষাব‌্যবস্থা ক্রমশ এক ভয়াবহ জায়গায় চলে যাচ্ছে। স্নাতকদের মধে‌্যও উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে বেকারত্ব। মানবসম্পদ তৈরির বিষয়টি দেশে সবচেয়ে উপেক্ষিত। কেন্দ্রীয় সরকার কিছুদিন বাদে বাদেই যে ‘পিরিয়োডিক লেবার ফোর্স সার্ভে’ রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে, তাতেই শ্রমের বাজারের নিয়মিত অবনতির চিত্রটি ফুটে উঠছে। দেশে অস‌াম‌্য বাড়ছে রকেট গতিতে।

দেশের এইসব সংকটের সুরাহা কি শুধু ‘রামরাজ্যে’ মিলতে পারে? প্রধানমন্ত্রী তঁার ভাষণে বললেন, ‘রাম সমাধান। রামই নীতি। রাম শুধু বর্তমান নয়, রাম অনন্তকালের।’ মোদির এই অাগামী-ভারতের কল্পনায় দেশ-বিদেশের লগ্নিকারীরা কতখানি অাশ্বস্ত হতে পারলেন, তা হয়তো সময়ই বলবে। কিন্তু দেশের অর্থনীতি কোন পথে চলবে, দেশের উন্নতি কোন পথে হবে, সেক্ষেত্রে যদি অর্থনীতিবিদ, প্রযুক্তিবিদদের জায়গায় ধর্মগুরু বা কতিপয় রাজনীতিবিদদের মতামত গুরুত্ব পেতে থাকে, তাহলে তা যে দেশের পক্ষে সুদিন বয়ে অানবে না, সে-কথা হলফ করে বলে দেওয়া যায়। স্বাধীনতার পর দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে উদার ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রর ভূমিকা ছিল, তা উপেক্ষা করার নয়। বিজ্ঞান ও অাধুনিক মনষ্কতার উপাদান এই ব‌্যবস্থারই উজ্জ্বল উদ্ধার। রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগে বড় পরিকাঠামো ও ভারী শিল্প নির্মাণের সময় জওহরলাল নেহরু বলতেন, ‘এগুলিই দেশের মন্দির।’ নেহরু সংঘ পরিবারের সবচেয়ে বড় শত্রু। মোাদি জমানায় নেহরুর আদর্শ ও দর্শন সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। কালচক্রের আবর্তন বলতে মোদি হয়তো মন্দির উদ্বোধনের পর সেই নেহরু জমানার প্রতিই ইঙ্গিত করলেন।

 

[আরও পড়ুন: ‘বেশরম’ হওয়াই শাস্তি! ক্যাটরিনা-আলিয়া ডাক পেলেও অযোধ্যায় ব্রাত্য দীপিকা?]

মন্দির উদ্বোধন কার্যত মোদির নির্বাচনী প্রচারেরও সূচনা করেছে। যদি মন্দির চত্বরে মোদির ভাষণকে সেই প্রচারের সূচনা বিন্দু হিসাবে ধরে নেওয়া যায়, তাহলে বলতে হয় যে, সুস্পষ্ট হিন্দুরাষ্ট্রর লক্ষ‌্যকে সামনে রেখেই বিজেপি আগামী লোকসভা ভোট লড়তে চায়। তৃতীয়বার মোদি ক্ষমতায় এলে সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটির বিদায় সুনিশ্চিত হবে। রাষ্ট্রের কোনও ধর্ম থাকা উচিত নয় বলে যে-বিধান দেশের সংবিধান ও শীর্ষ আদালত এতদিন দিয়ে এসেছে, তা কার্যত অসাড় প্রতিপন্ন হতে চলেছে।

মোদির এই নির্বাচনী প্রচার সূচনায় দেশের মানুষের কোনও সমস‌্যা ও সংকট উঠে আসেনি। মূল‌্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, শিক্ষার ভয়াবহ হাল, স্বাস্থ‌্য পরিষেবা থেকে বঞ্চনা, দারিদ্র‌, অসাম‌্য– কিছুই যেন আর ইস্যু নয়। হিন্দু রাষ্ট্র, রাম ও রামায়ণের মধ্যেই সব সমস‌্যার সমাধান খোঁজার এই বিপজ্জনক প্রবণতা ও আত্মম্ভরিতা দেশকে শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যাবে, তা চিন্তা করলে ভীত হওয়া স্বাভাবিক। রামমন্দির পাওয়ার উল্লাস ও উদ্‌যাপনের মধ্যে কি এই চিন্তা আদৌ আপামর দেশবাসীর রয়েছে? সেটাও একটা বড় প্রশ্ন।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement