shono
Advertisement

একাধিপত্যের সাধারণ নির্বাচন! ‘মুক্ত’ ও ‘ন্যায্য’ গণতান্ত্রিক যুদ্ধ বলতে কি সত্যিই কিছু রয়েছে?

একটি দল অর্থ ব‌্যয়ে একরোখা আধিপত‌্য কায়েম করলে পেশিশক্তির অসাম‌্য তৈরি হয়।
Posted: 05:09 PM Mar 22, 2024Updated: 05:09 PM Mar 22, 2024

নির্বাচনী বন্ডের ৫০ শতাংশেরও বেশি টাকা বিজেপির কাছেই যাবে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে! জাতীয় স্তরের প্রভাবশালী দল, ফলত যাবতীয় সম্পদের প্রতি তাবৎ আধিপত‌্য। কিন্তু, যখন একটি দলই কেবল একরোখা আধিপত‌্য কায়েম করে অর্থব‌্যয়ে, তখন পেশিশক্তির অসাম‌্য অবধারিত, যা সামগ্রিক প্রচারকে একতরফা করে তোলে। লিখলেন রাজদীপ সরদেশাই

Advertisement

২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচনের তোড়জোড় লেগে গিয়েছে বটে, কিন্তু সাবেক দামামার গুঞ্জনটুকু নেই! কারণ সম্ভবত, সাধারণ নির্বাচনী আদবকায়দায় ১০০ মিটার স্প্রিন্টের চেয়ে ম্যারাথন বেশি। গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে আড়াই মাসজুড়ে এর ব‌্যাপ্তি। উত্তেজনায় ঘাটতির আরও একটা কারণ থাকতে পারে– ফলাফল হয়তো ইতিমধে‌্যই পূর্বনির্ধারিত, সকলের জানা: সাম্প্রতিক স্মৃতিতে ফলাফলের এহেন অনিবার্যতা এর আগে কখনও এতটা জনমানসে প্রভাব ফেলেছে বলে মনে হয় না। অলৌকিক খুব যদি কিছু না ঘটে, তাহলে নরেন্দ্র মোদি (PM Modi) টানা তিনবার পঁাচ বছরের মেয়াদে জয়ী হয়ে তঁার চক্ষুশূল জওহরলাল নেহরুর রেকর্ড ছুঁতে চলেছেন। তবে, ফলাফল যতই পূর্বনির্ধারিত উপসংহার মনে হোক না কেন, একটা তেতো করা প্রশ্ন এখনও রয়ে গিয়েছে: ‘মুক্ত’ এবং ‘ন্যায্য’ গণতান্ত্রিক যুদ্ধ বলতে কি সত্যিই আর কিছু রয়েছে?

বিরোধী দল যে-বিশৃঙ্খল অবস্থায় আছে, তাতে সন্দেহ নেই। ‘ইন্ডিয়া’ জোট (INDIA) বাজেভাবে পর্যুদস্ত, অগণিত অন্তর্দ্বন্দ্বের সঙ্গে তাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। মহারাষ্ট্র এবং তামিলনাড়ু ছাড়া, এমন কোনও বড় রাজ্য নেই যেখানে জোট দৃঢ়ভাবে একত্রিত হয়েছে। গ্রুপিংয়ের মূল স্থপতি নীতীশ কুমার, আবারও পক্ষ পরিবর্তন করে রাজনীতির উলটপুরাণ খেলায় নিজেকে আরেকটি পদক দিয়েছেন; মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফিরে গিয়েছেন তঁার ‘একলা চলো রে’ মন্ত্রে; জয়ন্ত চৌধুরীর পক্ষে বিজেপির হয়ে যেতে তঁার পিতামহের জন্য একটি ভারতরত্নই যথেষ্ট ছিল; অরবিন্দ কেজরিওয়ালের (Arvind Kejriwal) ‘আপ’ রাজধানীতে কংগ্রেসের সঙ্গে গঁাটছড়া বেঁধেছে কিন্তু পাঞ্জাবের প্রতিটি আসনে তারা প্রতিদ্বন্দ্বী; এমনকী বামপন্থী, দিল্লিতে যাদের বিজেপি-বিরোধিতায় নৈতিক উচ্চতার শেষ নেই, সেই তারাই ওয়েনাডে রাহুল গান্ধী এবং কেরলজুড়ে কংগ্রেসের বিরোধিতায় বিন্দুমাত্র দ্বিধাদ্বন্দ্বে নেই। কংগ্রেস নিজেই পথভ্রষ্ট বিরোধী পক্ষের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে: যে-সময় রাহুল গান্ধী ভারত জোড়ো যাত্রা শুরু করেছিলেন, সেই সময় আসলে জোট গঠনের প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দেওয়া উচিত ছিল।

[আরও পড়ুন: শিক্ষায় ধর্মীয় বিভেদ কেন, উত্তরপ্রদেশের মাদ্রাসা আইন নিয়ে বড় রায় হাই কোর্টের]

এবং এসবের পরেও, বেহাল বিরোধী দলও নির্বাচনের সময় সমানে সমানে লড়াইয়ের সুযোগ পাওয়ার যোগ্য। নির্বাচন কমিশনের কথাই ধরুন, যার কিনা সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনায় আইনগতভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। একজন আম্পায়ারকে শুধুমাত্র কট্টরভাবে নিরপেক্ষ দেখালেই তো হল না, সেটা কাজে করে দেখাতে হবে। দুর্ভাগে‌্যর বিষয়, সাংবিধানিকভাবে বাধ্যতামূলক এই কমিশনের ভূমিকা ক্রমবর্ধমান তদন্তের আওতায় পড়ছে দিন-কে-দিন। ২০১৯-এ, প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় কমিশনের দেওয়া একাধিক ক্লিনচিটের উপর নির্বাচন কমিশনার অশোক লাভাসার ভিন্নমত নোটগুলি রেকর্ডে তো রাখাই হয়নি, উলটে তঁাকে পদ ও উক্ত দপ্তর থেকেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখন, ২০২৪-এ, কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে পূর্ণ আধিপত্য নিশ্চিত করেছে সুপ্রিম কোর্টের আদেশ প্রত্যাখ্যান করেই। এমনকী, নির্বাচনের সময়সূচিও উদ্বেগজনক প্রশ্ন তুলেছে: উদাহরণস্বরূপ, নির্বাচনকালীন হিংস্রতার কোনও ইতিহাস না থাকা সত্ত্বেও মহারাষ্ট্রে পঁাচ ধাপের ভোট নির্ধারিত হল কেন? তা কি শুধুমাত্র বিজেপির তারকা প্রচারক হিসাবে প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিটি পর্যায়ে রাজ্য জুড়ে প্রচার চালানোর জন‌্য?

নির্বাচন কমিশনের ক্রমহ্রাসমান বিশ্বাসযোগ্যতা গণতন্ত্র হিসাবে বৃহত্তর প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষয়ই প্রতিফলিত করে। সরকারের আচরণ আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে এতে। যেমন, গত বছর ‘বিকশিত ভারত যাত্রা’-য় মোদি সরকারের তামাম কৃতিত্বের বিষয়ে প্রচার করতে শীর্ষ আধিকারিকদের ব‌্যবহার করা হল যখন, তখন আমলাতন্ত্রের অবাধ রাজনীতিকরণ বিষয়ে তীব্র বিতর্কের উদ্রেক ঘটেছিল। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের আরেকটি আদেশে ছুটিতে থাকা সৈনিকদের ‘সৈনিক-দূত’ হিসাবে সরকারি স্কিম প্রচার করতে বলা হয়েছিল। বাস্তবে যা দৃশ‌্যায়িত হয়– একটি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এবং সরকারের মধ্যে ভেদরেখাগুলি অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।

[আরও পড়ুন: সুপ্রিম কোর্টে মিলল না জামিন, আবগারি দুর্নীতিতে আরও চাপে কে কবিতা

কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলির মধে‌্য, বিশেষত ইডি-কে হাতিয়ার রূপে ব‌্যবহার করে চলেছে কেন্দ্রীয় সরকার এই বিষয়টি নিশ্চিত করতেই, যাতে বিরোধী পক্ষের নেতারা সারাক্ষণ সন্ত্রস্ত ও তটস্থ থাকে। দিল্লির মদ কেলেঙ্কারিতে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে বারবার তলব করা এবং হালে নতুন ‘জল বোর্ড’ মামলা নিয়ে তরজা রীতিমতো টগবগিয়ে ফুটছে, আর সেটাই উদ্দেশ‌্য। নির্বাচনের প্রাক্কালে এই মদের মামলায় ‘ভারত রাষ্ট্রসমিতি’-র নেতা কে. কবিতা-কে গ্রেফতার করার সঙ্গে সঙ্গে, ইডি-র উপস্থিতি আপ নেতৃত্বের মধে‌্য দমবন্ধ পরিস্থিতি গড়ে তুলেছে। আয়কর বিভাগও কিছু কম যায় না: ২০১৮-’১৯ সালে ট্যাক্স রিটার্নে অসংগতির অভিযোগের জন্য কংগ্রেসের একাধিক অ‌্যাকাউন্ট বন্ধ করা হয়েছে, এবং ১০০ কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত করার ব‌্যবস্থাও করেছে তারা।

আরও বড় বিষয়, ইলেক্টোরাল বন্ডের (ELectroal Bond) বিশদ বিবরণ এ পর্যন্ত যা প্রকাশিত হয়েছে, তাতে একটা বিষয় স্পষ্ট। তদন্তকারী এজেন্সিগুলির দ্বারা জবরদস্তিমূলক পদক্ষেপ না থাকলে বন্ড অনুদানের এহেন ‘কুইড প্রো কুও’, অর্থাৎ ‘তুমি এটা দাও, বদলে সুরক্ষা বা ঋণ মকুব পাও’ গোছের অপ্রীতিকর চুক্তি ছাড়া এমন দানবিক পরিমাণ অর্থের আদানপ্রদান সম্ভবই নয়। শীর্ষ ৩০টি দাতা কোম্পানির মধ্যে ১৪টিই আছে এমন, যারা বন্ড কেনার সময় তদন্তমূলক পদক্ষেপের সম্মুখীন হয়েছিল এই শর্তে যে, অর্থগুলি প্রসিকিউশন থেকে ‘সুরক্ষা’ হিসাবে নেওয়া হচ্ছে! তা এই বন্ডের ৫০ শতাংশেরও বেশি টাকা বিজেপির কাছেই যে যাবে, তাতে আর আশ্চর্যান্বিত হওয়ার কী আছে। জাতীয় স্তরে প্রভাবশালী দল বলে কথা এবং যাবতীয় সম্পদের প্রতি তাদের তাবৎ আধিপত‌্য, তা সে নগদই হোক বা বন্ড। কিন্তু, যখন একটি দলই কেবল একরোখা আধিপত‌্য কায়েম করে অর্থ ব‌্যয়ে, তখন পেশিশক্তির অসাম‌্য তৈরি হয় অবধারিতভাবেই, যা সামগ্রিক প্রচারকে খুব একতরফা করে তোলে। বিভিন্ন মাধ‌্যম জুড়ে মোদি সরকারের একতরফা প্রচার দেখুন, তাহলেই ছবিটা আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে।

অবধারিতভাবে এই প্রসঙ্গে নিউজ মিডিয়া চলেই আসে। বর্তমানে এই জগতের সিংহভাগ এখন আর কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন দলের হয়ে ঢাকাচাপা দেওয়া তঁাবেদারির কাজ করে না, একদম সরাসরি বুক চিতিয়ে সরকার পক্ষের মুখপাত্র হয়ে গিয়েছে তারা। ২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচনের আগে, এপ্রিলে টিভি ভিউয়ারশিপ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ‘ব্রডকাস্ট অডিয়েন্স রিসার্চ কাউন্সিল’-এর করা একটি সমীক্ষা বলছে, টিভি এয়ারটাইমে অন‌্যান‌্য সমস্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রচারের তুলনায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তঁাকে কেন্দ্র করে বিজ্ঞাপন তিনগুণ বেশি সম্প্রচারিত হয়েছিল। সেগুলিতে নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপিকে প্রশস্তিসূচক বাক‌্যই কেবল! এবারে, সেই প্রবণতা পূর্বতর রেকর্ড ছাপিয়ে যাবে, এমনটাই ধরে রাখুন!

এমন নয় যে, এহেন ধামাধরা মিডিয়াবাজি ছাড়া নরেন্দ্র মোদি জিততে পারবেন না। কিংবা, রাষ্ট্রের প্রশাসনিক দখলদারি বা নজরদারির কীর্তিকলাপ ছাড়া তিনি হেরে যাবেন। আদপে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, ‘লার্জার দ‌্যান লাইফ’ ব্যক্তিত্ব তঁার, তঁার উদ্যমী উপস্থিতি এবং পেশিবহুল নেতৃত্বের মেজাজ সহজেই উপ-মহাদেশীয় বিশাল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে ফেলে। কারও কাছে তিনি বিশ্বগুরু, কারও কাছে তিনি একজন হিন্দু পুরোহিত, যুগোপযোগী প্রশাসক থেকে জাতীয়তাবাদী আইকন পর্যন্ত তঁার ভাবমূর্তির বিস্তার। তাই, ‘মোদি ছাড়া আবার কে!’ টাইপের জয়ধ্বনি স্লোগান এমন এক রাজনৈতিকতার প্রতীক, যেখানে সমস্ত ভিন্ন মতের কণ্ঠস্বর চেপে দেওয়ার তোড়জোড় হয়ে ওঠে। কিন্তু এমন এক ম্যাচ, যেখানে জয়ী দল নিশ্চিত, সেখানেও অন্য দল সমান সুযোগের দাবিদার। তাদের এই নূ‌্যনতম অস্বীকার করা মানে মৌলিক সুযোগ গণতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করা।

পুনশ্চ: সাম্প্রতিক নির্বাচন কমিশনের সাংবাদিক বৈঠকে আনকোরা এক আশ্বাসবাণী পেশ করেছে নির্বাচন কমিশনার। মডেল কোড লঙ্ঘন হিসাবে ঘৃণা-ভাষণের ক্ষেত্রে কীরকম পদক্ষেপ করা হবে, প্রশ্ন করার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার আশ্বস্ত করেন যে ‘যতই নামকরা রাজনীতিবিদ হোক না কেন’, ব্যবস্থা নেওয়া হবে! কমিশন সতি‌্যই কাজে করে দেখাতে পারবে তো?

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement