shono
Advertisement
SIR

যশোর রোড এবং একটি কবিতা, মনে করাচ্ছে এসআইআর?

এসআইআরে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন উদ্বাস্তুরাই।
Published By: Kishore GhoshPosted: 08:48 PM Nov 26, 2025Updated: 08:49 PM Nov 26, 2025

এসআইআরে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন উদ্বাস্তুরাই। যশোর রোডের বারাসত থেকে বনগাঁ অঞ্চলে প্রচুর মতুয়া বা নমশূদ্র সম্প্রদায়ের বাস। যাঁরা এসেছিলেন ’৭১-এর পর। এখন তাঁরা সবাই ভোট দিয়ে মন্ত্রী-বিধায়ক-সাংসদ নির্বাচিত করেন। তথাপি তাঁদের নাগরিকত্ব ফর্ম ফিল আপ করতে হচ্ছে। বলা হচ্ছে এই ফর্ম ফিল আপ করলে এসআইআরের ভয় নেই। লিখছেন কিংশুক প্রামাণিক

Advertisement

প্রখ‌্যাত আমেরিকান কবি অ‌্যালেন গিন্‌সবার্গ ১৯৭১ সালে ভারতে এসে লিখেছিলেন তাঁর বিখ‌্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। মাত্র একটি কবিতার জন‌্য অনেক বাঙালি তাঁকে মনে রেখেছে। পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের অসহনীয় অত‌্যাচারে পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা লক্ষ লক্ষ মানুষের রিফিউজি হওয়া জীবন কতটা দুর্বিষহ ছিল সে-কথা মাত্র একটি কবিতায় লেখা সহজ কাজ নয়।

অবশেষে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ তকমা ঘুচিয়ে স্বাধীন দেশ হল ‘বাংলাদেশ’। কবির কলমের জোরে বিশ্বের সামনে ‘মুক্তিযুদ্ধ’-র প্রাসঙ্গিকতা স্পষ্ট হয়ে উঠল। এখন সেই চেতনাকে মুছে দিয়ে ‘রাজাকারের নাতিপুতি’-রা যখন ঢাকার প্রশাসনিক ক্ষমতা নির্বাচন ছাড়াই দখল করে, এবং তার কোনও প্রতিবাদ সাড়া ফেলে না, তখন মনে হয় কবিতা পড়া কি ভুলে গিয়েছে বাংলাদেশের সুশীল সমাজ? অবশ‌্য জাতির পিতার মাথায় প্রস্রাব করা মানুষকে প্রশ্রয় দেওয়া একটি জাতির কাছ থেকে আর কী-ই বা আশা করা যায়!

কবি গিন্‌সবার্গ ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে কলকাতায় এসে যশোর রোড ধরে বনগাঁর দিকে গিয়েছিলেন। পথে ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে আসা সর্বহারা মানুষের কান্না, অত‌্যাচারে ক্ষতবিক্ষত নারীর দেহ ও ভুখা শিশুদের মৃত্যুমিছিল দেখে তিনি শিউরে উঠে লিখেছিলেন ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। লিখেছিলেন, একটি অপূর্ব সুন্দর পথের চিত্র কীভাবে বদলে গিয়েছে বাঁচতে চাওয়া মানুষের হাহাকারে। পরে কিংবদন্তি গায়ক বব ডিলানের সহায়তায় সেই কবিতা ‘গান’ হয়, এবং তা তুমুল জনপ্রিয়তা পায়।

সুনীল গঙ্গোপাধ‌্যায়, শক্তি চট্টোপাধ‌্যায়ের মতো ছয়-সাতের দশকে বঙ্গ সংস্কৃতির আধুনিকমনস্ক লেখক-কবিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল গিন্‌সবার্গের। নিয়মিত তাঁদের মধ্যে কথা হত। কলকাতায় এলে কবি কফি হাউসে যেতেন, সুনীলবাবুর বাড়িতেও তিনি গিয়েছিলেন। সেটা ১৯৬২ সাল হবে। কলকাতার সংস্কৃতি, আড্ডা, সাহিত‌্যচর্চা, ফুটপাথ দেখে তিনি ‘সিটি অফ জয়’-এর প্রেমে পড়েন।

বাংলা ও বাঙালিকে ভালবেসে ফেলা সেই মানুষটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবর পেয়ে আবার কলকাতা আসেন ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে। যুদ্ধক্ষেত্রে সেনা যায়, কামান যায়, বন্দুক যায়, সাংবাদিকও যায়। কিন্তু কখনও কখনও যে কবিরও যাওয়ার প্রয়োজন হয় গিন্‌সবার্গ তা দেখিয়েছিলেন।

যশোর রোডের পথে পথে উদ্বাস্তুস্রোত দেখার পর তিনি লেখেন এই কালজয়ী কবিতা। শুধু কবিতা লিখেই ক্ষান্ত হননি। পরে নিউ ইয়র্কের ম‌্যাডিসন স্কোয়‌্যার গার্ডেনে পণ্ডিত রবিশংকর ও জর্জ হ‌্যারিসনকে দিয়ে একটি কনসার্টের আয়োজন করেন। আমন্ত্রণ করেন আলি আকবর খাঁ-কে। তাঁর সেই কবিতা থেকে গান গাওয়া হয়। গেয়েছিলেন বব ডিলানের মতো জনপ্রিয় সংগীতশিল্পীরা।

রিফিউজিদের ত্রাণের জন‌্য অর্থ সংগ্রহ ছিল সামনে প্রচারমাত্র, আসলে এই কনসার্ট সারা পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের কথা জানতে পেরেছিল বিশ্ব। পাকিস্তানের বর্বরতার কাহিনি ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপ, আমেরিকার দেশগুলিতে। গানে গানে সুরের মূর্ছনায় এমন প্রতিবাদ ভাবা যায় না। সত্যি কথা বলতে কী, এরপর আর বাংলাদেশ গঠনের জন‌্য বিশ্বে জনমত গড়তে অসুবিধা হয়নি বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানদের।

সময় চলে যায়, চরিত্রগুলি হারিয়ে যায়, ইতিহাস ফিকে হয়। কিন্তু সত‌্য আড়ালে থাকে না।
সেই যশোর রোডে মঙ্গলবার সফর করতে করতে মনে পড়ছে প্রতিবাদী কবির কথা। মনে পড়ে যাচ্ছে তাঁর কবিতা। কতটা গভীরে গেলে একটি কবিতা দিয়ে যুদ্ধজয়ের কথা বলা যায়। অত‌্যাচারিত মানুষের অসহায়তা বিশ্বে তুলে ধরা যায়। কবিতাটির বাংলা তরজমা করেছিলেন বাংলাদেশের এক কবি।

দারুণ তাঁর ভাষান্তর–
লক্ষ শিশু দেখছে আকাশ অন্ধকার
উদরস্ফীত বিস্ফারিত চোখের ধার,
যশোর রোডে বিষণ্ণ সব বাঁশের ঘর
ধুঁকছে শুধু, কঠিন মাটি নিরুত্তর।

লক্ষ প্রাণের উনিশ শতক একাত্তর
উদ্বাস্ত যশোর রোড সব ধূসর,
হাঁটছে মানুষ বাংলা ছেড়ে কলকাতায়
সিক্ত মিছিল চলছে মানুষ নিঃসহায়।

মঙ্গলবার সকালে সেই যশোর রোডের পথ ধরে চলেছি, খুঁজছি সময়। এখন বদলে গিয়েছে সব। রিফিউজিদের ক‌্যাম্প কোথায়? তাদের নিয়েই গড়ে উঠেছে একের-পর-এক জনপদ। ছোট ছোট বাড়ি, পাড়া, ক্লাব, সবুজ ধানের খেত, স্কুল কলেজে বাজার, ব‌্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস, সব নিয়ে এক সুখী শহর বা এক সুখী গ্রাম।

এখন এখানকার বাসিন্দারা সবাই ভারতের ‘নাগরিক’। কেউ আর উদ্বাস্তু বাংলাদেশি নন। পথের ধারে মৃতদেহের পচা গন্ধ নেই, ক্ষুধার ক্রন্দন নেই, নেই একটু জলের জন‌্য হাহাকার। ৫৪ বছর পর যশোর রোডে প্রকৃত স্বাধীনতার মিছিল। ভিটেহারা মানুষ নতুন ভিটে পেয়ে ভাল আছেন। সুখে আছেন।

যশোর রোডের একটি প্রাচীন ইতিহাস রয়েছে। কলকাতা থেকে যশোর, যশোর থেকে নদিয়া হয়ে মুর্শিদাবাদের সংযোগ ছিল মুঘল শাসনের সময়। কলকাতা থেকে মাটির রাস্তাটি তৈরি হয়েছিল নবাবি আমলে। পরে ব্রিটিশ সরকার যশোরকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। তাদের সহায়তায় নড়াইলের জমিদার কালী পোদ্দার মাটির রাস্তাটিকে ঘোড়ার গাড়ি চলার উপযোগী করে তুলতে প্রচুর অর্থ ব‌্যয় করেন। ধনকুবের জমিদার তাঁর মায়ের ইচ্ছাপূরণ করতে নয়া রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। তাঁর মা মাঝে মাঝে গঙ্গাস্নান করতে যেতে চাইতেন কলকাতায়।

প্রায় ২ লক্ষ ৫৮ হাজার টাকা খরচ করে মায়ের জন্য সেই রাস্তাটি তৈরি করেন সেই জমিদার। ১৮৪২ সালে কাজ শেষ হয়। রাস্তার দু’-পাশে বসানো হয় রেন ট্রি। পরে তা বিশাল রূপ নিয়ে গোটা রাস্তাটিই ছায়াময় করে তোলে। ব্রিটিশরা সব রাস্তাতেই বড় বড় গাছ লাগাত। কারণ এতে যেমন ভূমিক্ষয় রোধ হয়, তেমনই পথিকদের সুবিধা হয়।

এখন যশোর রোডের গাছ কেটে সাফ করা হচ্ছে রাস্তা বড় করার দোহাই দিয়ে। রাস্তা সম্প্রসারণ অবশ‌্যই করতে হবে। পথ অপরিসর থাকলে উন্নয়ন থমকে দাঁড়ায় এ কথা ঠিক। কিন্তু বিশাল-বিশাল গাছ কেটে পথ তৈরির কোনও যুক্তি থাকতে পারে না। বিকল্প ভাবা যেতেই পারত। এই গাছের ছায়াই সেদিন ছিল রিফিউজিদের আশ্রয়।

দমদম থেকে যশোর, দূরত্ব প্রায় ১২০ কিলোমিটার। এর মধ্যে বেনাপোল সীমান্ত থেকে যশোর ৩৯ কিলোমিটার। অর্থাৎ, রাস্তার বেশিরভাগ অংশই এই বঙ্গে। ঐতিহাসিক কারণেই রাস্তার নাম বদল হয়নি। হয়তো হবেও না।

পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয়েছে ভোটার তালিকায় ‘বিশেষ নিবিড় সংশোধন’। যার পোশাকি নাম ‘এসআইআর’। ধারণা করা হচ্ছে, ‘এসআইআর’-এ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে উদ্বাস্তুরাই। যশোর রোডের বারাসত থেকে বনগাঁ অঞ্চলে প্রচুর মতুয়া বা নমশূদ্র সম্প্রদায়ের বাস। যারা এসেছিল ’৭১-এর পর। এখন তারা সবাই ভোট দিয়ে মন্ত্রী-বিধায়ক-সাংসদ নির্বাচিত করে। তথাপি তাদের নাগরিকত্ব ফর্ম ফিল আপ করতে হচ্ছে। বলা হচ্ছে এই ফর্ম ফিল আপ করলে এসআইআরের ভয় নেই। কীসের ভয়? কেন ভয়? এসআইআর শুরু হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই যশোর রোডের দু’ধারে নতুন করে আলোড়ন। মানুষ বিভ্রান্ত। আমরা কি ভারতীয় নাগরিক নই, আমরা কি ভোটার নই, তাহলে আধার কার্ড, রেশন ভোটার কার্ডের মূল‌্য কী!

মার্কিন কবি ৫৪ বছর আগে অসহায় মানুষের স্রোত দেখেছিলেন। এখন দেখছি, মানুষের মনে এক অনিশ্চয়তার কালো মেঘ। নতুন করে উদ্বাস্তু হওয়ার ভয়। কে ‘হিন্দু’ আর কে ‘মুসলিম’, কে ‘অনুপ্রবেশকারী’ আর কে ‘শরণার্থী’, এই বিচার থাকবে কি ‘এসআইআর’-এ? ভোটের অধিকার চলে গেলে ব‌্যাঙ্ক অ‌্যাকাউন্ট অটুট থাকবে তো? ছেলে স্কুলে যেতে পারবে তো?
থাকবে তো তার আশ্রয়? মানুষের মনে অনেক গভীর প্রশ্ন। সত্যিটা কী, সবাই জানতে চায়। এখন কি তবে আরও একটি কবিতা লেখার সময় এসে গেল যশোর রোড নিয়ে?

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
Advertisement