ইহুদিরা, অটোমান সাম্রাজ্যের এক অংশ (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত), প্যালেস্তাইনিদের নিজের দেশ, তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইছে। অথচ একদিন এই অটোমান সাম্রাজ্যে তারা মুক্তভাবে আশ্রয় পেয়েছিল। ইহুদিদের একবার ইতিহাসের এই অধ্যায়ের দিকে ফিরে তাকানোর সময় এসেছে। লিখছেন পঙ্কজকুমার চট্টোপাধ্যায়।
পঞ্চদশ শতকে স্পেন এবং পর্তুগাল থেকে বিতাড়িত ইহুদিদের অনেকেই অটোমান সাম্রাজ্যে আশ্রয় নেয়। অটোমান সাম্রাজ্য তখন মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্রস্থল। এখন নির্যাতিত ইহুদিরা কোনও মুসলিম দেশে আশ্রয় নিলে তা অদ্ভুতই শোনাবে! যাই হোক, সেই সময়ের স্পেন এবং অন্যান্য খ্রিস্টান দেশের তুলনায় অটোমান সাম্রাজ্য ইহুদি-সহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি অনেক বেশি সহনশীল ছিল।
সুলতান বেয়াজিত দ্বিতীয় মুক্ত বাহুতে ইহুদিদের স্বাগত জানিয়েছিলেন এই বলে যে, ক্যাথলিক রাজাদের ক্ষতি তঁার লাভ। অটোমান সাম্রাজ্যে অন্য অ-মুসলিমদের মতো ইহুদিদের বেশি কর দিতে হত। কিন্তু, তারা স্বাধীনভাবে নিজস্ব ধর্মাচরণ করতে এবং নিজেদের সম্প্রদায়গত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বজায় রেখে বসবাস করতে পারত। সাম্রাজ্যের যে কোনও দায়িত্ব পালনের কাজে ইহুদিদের দেখা যেত– সভাসদ পরামর্শদাতা এবং কূটনীতিক, ব্যবসায়ী এবং উৎপাদক, বাহক এবং রাজমিস্ত্রী। সাধারণ ধারণার বিপরীতে অসহনশীলতা ইসলামের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য নয়।
অনেকে ইসলামকে ‘যুদ্ধবাদী ধর্ম’ বলে দেখে, এবং মৌলবাদী মুসলিমরা সেই মতকে পরিপোষণ করে। সেই কারণেই অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে ‘ধর্মীয় যুদ্ধ’ হিসাবে অপব্যাখ্যা করা হয়েছে ‘জেহাদ’ শব্দকে, যার প্রকৃত অর্থ, যে কোনও যোগ্য লক্ষ্য অর্জনের প্রয়াস। মহম্মদের কথায়– ‘বিদ্বজ্জনের কালি শহিদের রক্তের চেয়ে পবিত্র’। এটা মেনে নিতেই হবে যে, নবজাগরণ সম্ভব হতই না– যদি না মুসলিমরা ধ্রুপদি গ্রিক এবং লাতিন বইয়ের আরবি ভাষায় অনুবাদ করে সংরক্ষণ না-করত, যাতে পরবর্তীকালে সেইগুলি ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদ করা যেতে পারে। ইউরোপের খ্রিস্টানরা ‘বিধর্মী’ বলে অবহেলা করে বা সক্রিয়ভাবে খ্রিস্টপূর্ব গ্রিক এবং লাতিন গ্রন্থসমূহ ধ্বংস করেছে।
ইসলামের বিরুদ্ধে আর-একটি অভিযোগ, এই ধর্ম বৈজ্ঞানিক প্রগতি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনাগ্রহী। মধ্য যুগে, মুসলিম-বিশ্ব গণিত এবং বিজ্ঞানে ইউরোপের তুলনায় অনেক বেশি অগ্রসর ছিল (বিশেষ করে দশম এবং একাদশ শতকে বাগদাদকে কেন্দ্র করে)। আইনি শিক্ষাতেও তাদের অগ্রগতি ছিল অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি বৈজ্ঞানিক শব্দের নাম করা যেতে পারে, যার উৎস আরবি ভাষায়– অ্যালকোহল, অ্যালক্যালি, অ্যালজেব্রা, অ্যালগরিদ্ম (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নির্যাস)। বাণিজ্য অনেক এগিয়ে ছিল: আরব ব্যবসায়ীরা পূর্বে কোরিয়া এবং পশ্চিমে আফ্রিকার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল– ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের কথা না হয় বাদ দিলাম। মুহম্মদ একজন ব্যবসায়ী ছিলেন বলেই ব্যবসায়ীদের উচ্চ সামাজিক মর্যাদা ছিল, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। ব্যবসায়ীর ধর্ম বলেই ইসলাম চুক্তি (কনট্র্যাক্ট) আইনকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেছিলেন। উনবিংশ শতাব্দীর আগে ইউরোপে আইনে শিক্ষিত বিচারপতি দেখা যেত না।
অন্য সংস্কৃতির বিপরীতে ইসলামের আর-একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে তাকে সাহায্য করেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় হিন্দু ধর্ম বা পূর্ব এশিয়ায় কনফুসিয়ানিজ্মে যে-জাতপ্রথা আছে, তা মুসলিম সংস্কৃতিতে নেই। জাতপাতের ভিত্তিতে কর্মবিভাজন ইসলাম ধর্মে নেই। তাই মুসলিম সংস্কৃতিতে সহজাতভাবে উন্নয়ন বিরোধী কিছু নেই। এমন অনেক বিষয় এই সংস্কৃতিতে আছে, যা অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে খাপ খায়। ইসলাম যে অর্থনৈতিক প্রগতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ– মালয়েশিয়া এবং দুবাই।
অথচ হালে সারা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করছে, বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ইজরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে চরমপন্থী দক্ষিণপন্থী সরকার ৭ অক্টোবর ২০২৩ হামাসের ইহুদিদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে গাজা-সহ সমস্ত প্যালেস্টাইনের উপর যে গণহত্যা এবং ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে, তার ভয়াবহতা অভূতপূর্ব। ইতিমধ্যে ৬২ হাজার গাজাবাসী মারা গিয়েছে, যার মধ্যে বেশির ভাগ মহিলা এবং শিশু। অনাহারে এবং অপুষ্টিজনিত কারণে প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে অগণিত শিশু। মাঝে মাঝে মদতকারী আমেরিকা সরকার দায়সারা ভাবে ইজরায়েল এবং হামাস নেতাদের আলোচনার টেবিলে বসে যুদ্ধবিরতির দিকে এগতে আহ্বান জানাচ্ছে। কাতারে ড্রোন হামলা করে নেতানিয়াহু বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি যুদ্ধবিরতি চান না, বরং গাজার অস্তিত্বকে পৃথিবীর বুক থেকে মিলিয়ে দিতে চান।
শুধু নেতানিয়াহু নন, বিশিষ্ট ইহুদিদের মধ্যে এক কমেডিয়ান জেরি সেনফেল্ড সম্প্রতি আমেরিকার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্যালেস্তাইন আন্দোলনকে ইহুদি-বিরোধী আখ্যা দিয়েছেন এবং ‘কু ক্লুক্স ক্লান’-এর (‘কেকেকে’) সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি আরও বলেছেন যে, ‘মুক্ত প্যালেস্টাইন’ উচ্চারণ করে আন্দোলনকারীরা সত্যের অপলাপ করছে এবং তাদের আসল উদ্দেশ্য ইহুদি-বিরোধিতা। এই হল সাংস্কৃতিক জগতের এক উল্লেখযোগ্য ইহুদি প্রতিনিধির মনোভাব বা আচরণ। এটা ভুলে গেলে চলবে না এই সবের মূলে রয়েছে ইসলাম বিদ্বেষ।
এখন, ইহুদিরা, অটোমান সাম্রাজ্যের এক অংশ (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত), প্যালেস্তাইনিদের নিজের দেশ, তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইছে। অথচ একদিন এই অটোমান সাম্রাজ্যে তারা মুক্তভাবে আশ্রয় পেয়েছিল। ইহুদিদের একবার ইতিহাসের এই অধ্যায়ের দিকে ফিরে তাকানোর সময় এসেছে।
(মতামত নিজস্ব)
