২৪ হাজার ৬৭৮টি দুর্ঘটনার বলি ২১ হাজার ৮০৩ জন। রেলের ট্র্যাকে এত সংখ্যক মৃত্যু। ফোন নিয়ে পারাপারের প্রবণতাও বেশ দায়ী।
মোটরম্যানদের নিজস্ব আড্ডায় চর্চিত হয় নানা অস্বস্তিকর ঘটনা, যা প্রকাশ্যে আসে না সাধারণত, আসা উচিত নয় বলেই। বর্ষীয়ান একজন মোটরম্যানের অভিজ্ঞতা– ট্র্যাকে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল ছেলেটি, একটি তরুণী মেয়ের সঙ্গে। মাঝ তিরিশের কাছে বয়স। স্বাস্থ্যবান। হাফ শার্টের হাতা বাইসেপ্সের কাছে গোটানো। বারবার হর্ন দেওয়া সত্ত্বেও কেন যে ছেলেটি সরতে পারল না, অথচ মেয়েটি শেষ মুহূর্তে নিজেকে বাঁচিয়ে নিল– সেই প্রৌঢ় মোটরম্যান এখনও ধরতে পারেন না! মারলেন, গতিতে। ছেলেটির ছিটকে গিয়ে সামনে পড়া ও তালগোল পাকাতে আর কতক্ষণ, তার তীব্র আর্তকণ্ঠ এখনও মোটরম্যানকে হন্ট করে। এ অ্যাক্সিডেন্ট প্রি-মোবাইল যুগের।
রেললাইন ধরে কত মানুষ দলবদ্ধভাবে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফেরে, খোশগল্প করতে করতে। হঠাৎ চলে আসা ট্রেন মুহূর্তে তাদের জীবনরেখা তছনছ করে দেয়। আবার কত মানুষ তাড়াতাড়ির মাথায় এক প্ল্যাটফর্ম থেকে অন্য প্ল্যাটফর্মে যেতে গিয়ে ট্রেনের রাক্ষুসে থাবায় পড়ে। ট্রেনের ট্র্যাক সিনেমায় বড়ই দৃশ্যশোভন। ক্যামেরা যে কত কেরামতি করে ট্র্যাক ঘিরে! চিত্রনাট্যে আসে কতই না বাঁক। যেমন– ভিলেনকে, ট্র্যাকের দু’-পাশ থেকে ধরে রেখেছে দু’জন নায়ক, আর ছুটে এসে ট্রেন গিলে নিল তাকে, এভাবেই পাপের শাস্তি। হিন্দি সিনেমায় দেখানো হয়েছে এমন দৃশ্য। স্মাগলিংয়ের সোনা পাচার করার জন্য ট্রেনলাইনের মাঝখান থেকে ফিসপ্লেট সরিয়ে লাইন প্রথমে বিপর্যস্ত করে দেওয়া হল, তারপর সোনা পাচার সেরে, যখন সেই লাইন মেরামত করা হচ্ছে, ওদিক থেকে হুড়মুড়িয়ে ছুটে আসছে গতিমান ট্রেন, তখন একজন শাগরেদ দিল রণে ভঙ্গ। ফিসপ্লেট লাগানো সম্পূর্ণ হয়নি। কী হবে? ট্রেন পড়ল বলে দুর্ঘটনার কবলে! অসমসাহসী নায়ক একটি শাবলের ফলা ফিসপ্লেটের গর্তে ভরে রেখে চলন্ত ট্রেন ও পরিবহণরত যাত্রীদের বাঁচিয়ে দেয়। বেশ মাখো-মাখো স্বপ্নপূরণের দৃশ্য। ‘নায়ক কী না পারে’ মার্কা। সেজন্যই বাস্তবের সঙ্গে এর অবনিবনা। আবার বাস্তবের ছায়া নেই বলেই তো এত রোমহর্ষক ফ্রেমে নায়ককে আরও বড় ও বিপুল বলে মনে হতে থাকে। বাজি রেখে রেলের ট্র্যাক ধরে পালা করে ছুটবে দু’জন। রেস। সেই ট্র্যাকের সামনে থেকে ছুটে আসবে ট্রেন, মুখোমুখি। চ্যালেঞ্জ হল: কে, কতদূর যেতে পারে। সিনেমার দৃশ্য, অনেকটা কাজ এমনভাবে করা যেতে পারে– যার জন্য সরাসরি অংশ নিতে হবে না নায়ককে। কিন্তু আমির খান, পারফেকশন-প্রিয়তা দেখাতে গিয়ে, প্রায় মৃত্যুর মুখে পড়েছিলেন এই দৃশ্যের শুটিংয়ে।
রেলের ট্র্যাক নাকি দেশের সর্ববৃহৎ ‘মুক্ত শৌচালয়’! কিন্তু প্রকৃতির ডাকে সাড়ার চেয়ে, মোবাইল ধরে হাঁটতে গিয়ে অনেক মানুষ মারা যায় ট্রেনের ধাক্কায়। ‘এনসিআরবি’-র রিপোর্ট বলছে– ২০২৩ সালে, ২৪ হাজার ৬৭৮টি দুর্ঘটনায়, ২১ হাজার ৮০৩ জনের প্রাণ গিয়েছে। এরপরেও ‘স্বভাব যায় না মলে’! যান্ত্রিক ত্রুটি বা মোটরম্যানের অবহেলাও থাকে দুর্ঘটনার নেপথ্যে; কিন্তু প্রাণ যার, সুরক্ষার দায় তারই কি বেশি নয়?
