shono
Advertisement

মারাঠি অস্মিতা ও সংরক্ষণের দ্বন্দ্ব

মহারাষ্ট্র এখন যেন ঘাড়ভাঙা উন্নয়ন মডেল!
Posted: 05:10 PM Nov 03, 2023Updated: 05:10 PM Nov 03, 2023

গত ৫ বছরে দেশের আর কোনও রাজ্যে এত রাজনৈতিক জলঘোলা হয়নি, যতটা না মহারাষ্ট্রে হয়েছে। আর তার সাম্প্রতিকতম সংযোজন- মারাঠি সংরক্ষণের দাবিজনিত রাজনীতি ও অশান্তি। যার জন‌্য ‘মহারাষ্ট্রীয় অস্মিতা’-র এত নামডাক- সামাজিক সংস্কার এবং অর্থনৈতিক উন্নতিই ছিল যার পরিচয়- এখন সেখানে সংরক্ষণের দাবি ছাড়া আর কোনও বিষয় নেই। মহারাষ্ট্র এখন যেন ঘাড়ভাঙা উন্নয়ন মডেল! কলমে রাজদীপ সরদেশাই

Advertisement

 

০ বছরের টিংটিঙে রোগা, অপেক্ষাকৃত অপরিচিত এক ব‌্যক্তি হঠাৎই হয়ে উঠেছেন এই সংরক্ষণ সংক্রান্ত প্রতিবাদের মুখ। মনোজ জারাঙ্গে পাটিল। যেভাবে তিনি এমন তাৎক্ষণিক কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন মারাঠা রাজনীতিতে, তাতে অবস্থা এমন যে, মহারাষ্ট্র সরকার কোর্টের সিদ্ধান্ত এড়িয়ে হয়তো মারাঠি সংরক্ষণের যাবতীয় সুবিধা এক্ষুনি বলবৎ করে দিল।

৩৫ বছর আগের কথা। মুম্বইতে যখন আমি সাংবাদিকতার কাজে যুক্ত হলাম, এক সিনিয়র সহকর্মী আমাকে উপদেশ দিয়েছিলেন, ‘রাজনীতি নিয়েই যদি কাজ করতে চাও, রাজনীতির নাটক যদি প্রত‌্যক্ষ করতেই হয়, তাহলে মুম্বইতে সেসবের স্বাদ তুমি পাবে না। এখানে তো কেবল কংগ্রেসের অন্তর্দ্বন্দ্ব ছাড়া আর কিস্যু নেই।’ কিন্তু গত পাঁচ বছরে দেশের রাজনীতির চালচিত্র সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে, এবং দেশের আর কোনও রাজ্যে এত রাজনৈতিক জলঘোলা হয়নি, যতটা না মহারাষ্ট্রে হয়েছে। মাত্র পাঁচ বছরে তিনবার বদলেছে মুখ‌্যমন্ত্রীর মুখ, নাটকীয়ভাবে দল ভাঙতে দেখা গিয়েছে, এমনকী ঘটেছে পারিবারিক ভাঙনও, ঘটেছে সূর্যোদয়ের আগেই ভোররাতে শপথগ্রহণ, তারপর টানা আইনি জটলা- একটার পর একটা বিশৃঙ্খল মুহূর্তের মুখোমুখি হয়েছে এই রাজ‌্য। আর সাম্প্রতিকতম সংযোজন হল,
মারাঠা সংরক্ষণ নিয়ে আলোড়ন, যা মহারাষ্ট্রর জায়গায় জায়গায় কুৎসিত আকার নিয়েছে। এবং এই অশান্তি একনাথ শিণ্ডের সরকারকে ভয়ংকর সংকটে ফেলে দিতে পারে যে কোনও মুহূর্তে।

এমন সব অভাবনীয় উলটপুরাণের মধ্যে, ৪০ বছরের টিংটিঙে রোগা, অপেক্ষাকৃত অপরিচিত এক ব‌্যক্তি হঠাৎই হয়ে উঠেছেন এই সংরক্ষণ সংক্রান্ত প্রতিবাদের মুখ। মনোজ জারাঙ্গে পাটিল। তাঁর অনশন এবং গত সেপ্টেম্বরে তাঁর সমর্থক ও মহারাষ্ট্র পুলিশের মধ্যে দ্বন্দ্বের ঘটনা তাঁকে রাজনৈতিকভাবে এমন এক উচ্চতায় তুলে দিয়েছে যে, তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন‌্য উদ্বেল হয়ে প্রায় প্রত্যেকটা রাজ্যের নেতা-মন্ত্রী এসে পৌঁছচ্ছেন জালনায়, যে-জায়গাটি এই প্রতিবাদের মূল কেন্দ্র। ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বলছে, মনোজ জারাঙ্গে পাটিল আদপে এক কাঠপুতলি মাত্র, তাঁকে এই অবস্থানে বসিয়েছে বিরোধী পক্ষ। উদ্দেশ‌্য: শিণ্ডে সরকারকে সমূলে উৎপাটন। বিজেপি যদি রাষ্ট্রযন্ত্রের শক্তি প্রয়োগ করে থাকে, উদ্ধব ঠাকরের সরকারকে ধসিয়ে দিতে তারা যেমন বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে লেলিয়ে দিয়েছিল, তেমনই এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন‌্য রাস্তার ক্ষমতাকে কাজে লাগানোর জন‌্য মহাবিকাশ আঘাড়ি-কে দোষী ঠাওরানো যায়। মোটকথা, সামনের বছরেই লোকসভা নির্বাচন এবং এই রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনও। ফলে, কেউ-ই কাউকে ছেড়ে কথা বলছে না।

[আরও পড়ুন: ছেলে বিক্রি! দেশের ঘুণ ধরা অর্থনীতির দুঃসহ ছবি?]

তবে এ-কথাও মানতেই হবে, মারাঠাদের এই প্রতিবাদের সূত্রপাত কিন্তু রাতারাতি ঘটেনি। বেশ কিছু সময় ধরে এই সংরক্ষণের চাপানউতোর চলছে, যা আসলে রাজ্যের রাজনীতির ভাঙনেরই ফলাফল। দেশের স্বাধীনতার পর প্রথম পাঁচটি দশক জুড়ে, মহারাষ্ট্রর রাজনীতি যথেষ্ট স্থিতিশীল ছিল। কারণ, রাজ্যের মধ্যেকার অশান্তি মিটে যেত কংগ্রেসের বিশাল তাঁবুর মধ্যেই। আর, এই একাধিপত‌্যময় রাজনীতির আত্মা আসলে মহারাষ্ট্রের মারাঠি অস্মিতা। এই রাজ্যের ১৯ জন মুখ‌্যমন্ত্রীর মধ্যে (বর্তমান একনাথ শিণ্ডে-কে ধরে) ১২ জনই মারাঠি। রাজ্যের প্রত‌্যন্ত এলাকায় প্রায় প্রতিটি চিনি সমবায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা ব‌্যাঙ্কিং ক্ষেত্রেও মারাঠিদেরই আধিপত‌্য।

১৯৪৭-পরবর্তী সময়কালে, বিচক্ষণ কংগ্রেস নেতা যশবন্তরাও চভন মারাঠা-পরিচালিত অ-ব্রাহ্মণ জাতিগুলিকেও একজোট করতে সমর্থ হয়েছিলেন, বিভিন্ন শ্রেণির মানুষদের মধ্যে পৌঁছে। সেখানে যেমন দলিত ছিল, তেমনই ছিল মুসলিমও। কিন্তু, ক্রমশ রাজনীতি ও অর্থনীতি এমন একটা চৌহদ্দিতে গিয়ে আটকে গেল যে, উঁচু জাতির মারাঠিরাই হয়ে উঠল ক্ষীর খাওয়া। সেটা এমনই আকার নিল যে, অন‌্যান‌্য জাতপাতের মানুষ নিজেদের ক্রমশ প্রান্তিক মনে করতে লাগল তো বটেই, একই সঙ্গে বৈষম‌্যও বাড়ল চড়চড়িয়ে। গত শতকের নয়ের দশকে বিজেপির উত্থান হল যখন, মহারাষ্ট্র কেবলই যে হিন্দুত্বের আবেদনে গা ভাসাল, তা-ই নয়, একই সঙ্গে বাড়ল অদ্ভুত এক সামাজিক কূট, ছোটকথায় যার নাম ‘মাধব’ (MADHAV). অর্থাৎ মালি, ধঙ্গর এবং বাঞ্জারি অনগ্রসর সম্প্রদায়গুলির প্রভাবও বাড়ল, এবং প্রত্যেকের মধ্যেই ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের অপার উচ্চাশা। কংগ্রেস-চালিত সরকারের সময় মারাঠি অস্মিতা প্রায় অখণ্ড থাকলেও, বর্তমানে বিভিন্ন জাতের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই হয়ে উঠেছে হিংস্র।

আদপে ক্রমশ দুষ্প্রাপ‌্য সম্পদের অধিকার কায়েম করাটাই এই মারাঠি সংরক্ষণের উৎস। সেই দুষ্প্রাপ‌্য সম্পদ আর কিছু নয়, শিক্ষা এবং সরকারি চাকরি। উপহাসের বিষয়, এককালে যারা উঁচু জাতের মারাঠি বলে নিজেদের কলার তুলত, এখন তারা-ই নিজেদের ‘কুনবি’ জাতি বলে পরিচয় দেওয়ার জন‌্য পাগলপ্রায়। নিজেদের পারিবারিক শিকড় দেখানোর জন‌্য নিজামের প্রাচীন দলিল-দস্তাবেজ তুলে আনছে প্রামাণ‌্য হিসাবে, সংরক্ষণের সুবিধা পাওয়ার লোভে। কয়েক হাজার মারাঠি ইতিমধ্যে কুনবি জাতির সার্টিফিকেট পেয়েও গিয়েছে। ফলে, বোঝাই যাচ্ছে বর্তমান মহারাষ্ট্র সরকার কতটা মরিয়া হয়ে উঠেছে এই ঝড়কে সাময়িকভাবে শান্ত করার জন‌্য।

রাজনৈতিকভাবে, মহারাষ্ট্রর কোনও পার্টি-ই সংরক্ষণের এই দাবি অগ্রাহ‌্য করতে পারবে না, কারণ তাতে একটা বিরাট অংশের ভোটব‌্যাঙ্ক তাদের হাতছাড়া হবে। মুখ‌্যমন্ত্রী একনাথ শিণ্ডে খুব ভাল করেই বুঝতে পারছেন যে, নিজের গদি বাঁচাতে গেলে এখন তাঁকে মারাঠি নেতা হিসাবে ঢাক পেটাতে হবেই, আবার ওদিকে, উপমুখ‌্যমন্ত্রী অজিত পাওয়ারও হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছেন, এই সংরক্ষণ বিষয়ে কোনওরকম উদাসীনতা বা অবহেলা দেখা গেলেই তাঁর কাকা শরদ পাওয়ার সেই সুযোগের সদ্‌ব‌্যবহার করতে ছাড়বেন না। আর-এক উপমুখ‌্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ, তাঁর অবস্থানও কিছু কম অভাবনীয় নয়। অ-ব্রাহ্মণ এক রাজনৈতিক পরিসরে তিনি এক ব্রাহ্মণ নেতা। ফলে, তাঁর পক্ষে মারাঠি সংরক্ষণ নিয়ে কোনও আখের গোছানোর সুযোগ নেই।

কিন্তু, সংরক্ষণের সুবিধা দেওয়া বলতেই সহজ, কাজে কঠিন। ২০২১-এ, সুপ্রিম কোর্টে পাঁচজন বিচারকের একটি বেঞ্চ সর্বসম্মতিক্রমে ৫০ শতাংশ কোটার সীমা লঙ্ঘন-সহ ১৬ শতাংশ ‘মারাঠি কোটা’ বাতিল করে দেয়। চলতি বছরের শুরুর দিকে এই সিদ্ধান্তের নিরিখে একটি পর্যালোচনার আবেদন দায়ের করা হলেও, তা বিফলে যায়। কোর্ট সরাসরি জানিয়ে দেয়, মারাঠি সংরক্ষণ সম্পূর্ণত অসাংবিধানিক। কিন্তু, এখন, সংরক্ষণের দাবি নিয়ে যে-যুদ্ধ চলছে, তা নামেই সাংবিধানিক বাধা অতিক্রমের লড়াই, বরং অনেক বেশি করে অবাধ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। জারাঙ্গে পাটিলের মতো ব‌্যক্তিত্বের আইনি সুবিধার কোনও জায়গাই নেই, কিন্তু তিনি হুমকি দিচ্ছেন, যতক্ষণ না তাঁর দাবিগুলি মেনে নেওয়া হবে, ততক্ষণ তিনি তাঁর প্রতিবাদ চালিয়ে যাবেন। যেভাবে তিনি এমন তাৎক্ষণিক কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন মারাঠার রাজনীতিতে, তাতে অবস্থা এমন যে, মহারাষ্ট্র সরকার কোর্টের সিদ্ধান্ত এড়িয়ে হয়তো মারাঠি সংরক্ষণের যাবতীয় সুবিধা এক্ষুনি-এক্ষুনি বলবৎ করে দিল। প্রভাবশালী বিধায়কদের বাড়িতে যেভাবে হামলা চালাচ্ছে উত্তেজিত জনতা, তাতে বোঝাই যাচ্ছে, এই সংরক্ষণের দাবি কতটা দুর্বিনীত এবং সেখানে আইন-কানুনের কোনও ভয়ভীতি নেই। জারাঙ্গে পাটিল হতেই পারেন এক অমীমাংসিত রাজনীতির দাবাখেলায় নিতান্ত বোড়ে, কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে প্রত্যেকটা নেতাই কিস্তিমাত করার জন‌্য মরিয়া হৃদয় হয়ে উঠেছে।

আর এসবের কারণে, মহারাষ্ট্রকে এমন এক ঘাড়ভাঙা উন্নয়ন মডেলের মধ‌্য দিয়ে অশান্তির মাশুল দিতে হচ্ছে যে, কৃষিক্ষেত্রে সংকট ক্রমশ বাড়ছে, ঘুস দেওয়া-নেওয়ার খেলা চলছে। যার ফলে, তরুণ প্রজন্ম রীতিমতো বীতশ্রদ্ধ, হয়রান। ক্ষমতালোভী নেতাদের যখন দল ছাড়াই একগুচ্ছ মাতব্বরি, যেখানে আদর্শগত আনুগত‌্য বলতে কিছু নেই, এবং তারা যখন কৃষকের আয়, চাকরি এবং অবনমিত সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে নিরুচ্চার থাকে, তখন সেই শূন‌্যস্থান এসে পূরণ করে নির্দয় জাতপাতখোর ও সাম্প্রদায়িক যোদ্ধারা। যার জন‌্য ‘মহারাষ্ট্রীয় অস্মিতা’-র এত নামডাক- সামাজিক সংস্কার এবং অর্থনৈতিক উন্নতিই ছিল যার পরিচয়- এখন সেখানে সংরক্ষণের দাবি ছাড়া আর কোনও বিষয়ই নেই। যা থেকে বোঝা যায়, রাজ্যের দশা ক্রমশ বেহাল হয়ে উঠছে।

পুনশ্চ রাজ্যের বেশিরভাগ নেতাই একান্তে স্বীকার করেছেন যে, মারাঠিদের এই সংরক্ষণের দাবি আদপে অন‌্যান‌্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষদের মধ্যে আরও ক্ষোভ বাড়াবে। কারণ, তারা আরওই কোণঠাসা হয়ে উঠবে। ‘কিন্তু, কেউই সর্বসমক্ষে এই দাবির বিরুদ্ধে কথা বলবে না, কারণ ভোটের মরশুম যে’- এই স্বীকারোক্তিও শুনতে হল বরিষ্ঠ এক নেতার থেকে। কোনও সন্দেহ নেই, এক সংরক্ষণের ভূত যদি প্রদীপ থেকে বেরিয়ে পড়ে, তাকে আর প্রদীপবন্দি করা যায় না।

[আরও পড়ুন: গাজা যুদ্ধে ট্রাপিজের খেলায় ভারত, কোন পথে হাঁটছে মোদি সরকার?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement