প্রযুক্তি ও পূর্বাভাসের যুগে বিপর্যয় আসছে জানার পরও যদি তা মোকাবিলার প্রস্তুতি না-থাকে, তবে তা অযোগ্যতা নয়, প্রশাসনিক অবহেলা।
কাগজে-কলমে এ-বছর যেন আশীর্বাদ। স্বাভাবিকের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। ফলে খরিফ মরশুমে চাষের পরিমাণ বেড়েছে, জলাধার ভরে উঠেছে। সংখ্যার বিচারে এটি সমৃদ্ধির চিত্র। কিন্তু পরিসংখ্যানের আড়ালে লুকিয়ে আছে বাস্তবের এক অন্য ছবি। যেখানে নদী উপচে গিয়েছে, পাহাড়ে ধস নেমেছে, গ্রাম-শহর ডুবে গিয়েছে, আর হাজার-হাজার কৃষক তঁাদের ফসল ও ঘর হারিয়েছেন। তাই প্রকৃতির এই ‘অধিক বৃষ্টি’ যতটা আশীর্বাদ, ততটাই আবার অভিশাপও হয়ে দেখা দিয়েছে।
হিমাচলপ্রদেশ, জম্মু-কাশ্মীর ও পাঞ্জাবের মতো রাজ্যে বর্ষার তাণ্ডব প্রায় যুদ্ধক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছে। নদীগুলির জলের চাপ বেড়েছে এতটাই যে, বাঁধ ও রাস্তা ভেঙে গিয়েছে, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বহু এলাকা। পাঞ্জাবের বিস্তীর্ণ ফসলি জমি এখন অ-চাষযোগ্য হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে, শহরাঞ্চলে দেখা গিয়েছে সেই চিরপরিচিত দৃশ্য– ঘণ্টার পর ঘণ্টা জলমগ্নতা, নিকাশির অক্ষমতা, বেহাল রাস্তাঘাট। অতিবৃষ্টি সেখানে আর প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়, বরং পরিকাঠামোগত ব্যর্থতা ও প্রশাসনিক অদূরদর্শিতার নির্মম প্রতিফলন।
আবহাওয়া দপ্তর এপ্রিলেই জানিয়েছিল, এ বছর মৌসুমি বৃষ্টি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হবে। প্রশ্ন উঠছে, পূর্বাভাস যথাযথ হলেও প্রস্তুতি কোথায় বা কত দূর? প্রশাসন এখনও অতিবৃষ্টিকে ‘প্রকৃতির দান’ ভেবে নিশ্চিন্ত থাকে। খরার শঙ্কা এলেই সব দফতর একত্রভাবে ‘যুদ্ধকালীন তৎপরতা’ দেখায়, অথচ অতিবৃষ্টির সতর্কবার্তা যেন কেউ গায়েই মাখে না। এই মানসিকতা বিপজ্জনক। কারণ, অতিবৃষ্টি এখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবদুষ্ট, এর মোকাবিলা করতে হবে নীতি ও প্রযুক্তিগতভাবে।
এখানেই আসে দৃষ্টিভঙ্গির প্রসঙ্গ। ‘ক্লাউডবার্স্ট’, ‘অস্বাভাবিক বর্ষণ’, ‘প্রাকৃতিক প্রলয়’– এই শব্দগুলি আমরা সহজভাবে ব্যবহার করি। এদিকে, বাস্তব বলছে– পরিকল্পনাহীন নির্মাণ, নদীর পার দখল, পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি, বনাঞ্চল ধ্বংস– এসবই বর্ষাকে বিপর্যয়ে পরিণত করছে। অর্থাৎ, এ-কথা বলা ভুল হবে না– প্রকৃতির দ্বারা নয়, মানুষেরই তৈরি এই সংকট। তাই ভারতের এখন দরকার বর্ষার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন।
বৃষ্টি মানেই কৃষি সমৃদ্ধি নয়, তা হতে পারে বৃহত্তর পরিকাঠামোগত চ্যালেঞ্জের মাপকাঠি। প্রতিটি রাজ্যে নদী ব্যবস্থাপনা, শহুরে নিকাশি পরিকল্পনা, জলাধার সংস্কার, ভূমিধসপ্রবণ অঞ্চলে নির্মাণনীতি: সবই পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। প্রযুক্তি ও পূর্বাভাসের যুগে আমরা যদি বিপর্যয় আসছে জানার পরও প্রস্তুত না থাকি, তবে তা কেবল অযোগ্যতা নয়, প্রশাসনিক অবহেলাও। বর্ষাকে আর ‘দেবতার কৃপা’ কিংবা ‘অভিশাপ’ হিসাবে দেখা যাবে না। এটি এখন নীতিনির্ধারণ ও দায়িত্ববোধের পরীক্ষা। ভারী বৃষ্টি এলে যদি মানুষ, ফসল ও পরিকাঠামো ভেসে যায়, তবে তা প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, একেবারেই মানবসৃষ্ট বিপর্যয়। আর, সেই স্বীকারোক্তিই এখন ভারতের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বর্ষার পাঠ।
