সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: “মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘মোল-লা’রা ক’ন হাত নেড়ে/ ‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে’/ ফতোয়া দিলাম– কাফের কাজী ও,/ যদিও শহীদ হইতে রাজী ও!/ ‘আমপারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!/ হিন্দুরা ভাবে, ‘পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’” ‘আমার কৈফিয়ৎ’-এর এই পঙ্ক্তিগুলো যখন লিখেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, তারপর প্রায় শতাব্দী পেরতে চলল, কিন্তু এর বাস্তবতা এতটুকুও পাল্টায়নি। সম্প্রতি নবদ্বীপের রাধারাণী মন্দিরের হিন্দু নাটমন্দিরে আয়োজিত হয়েছিল একটি রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা। সেখানে নজরুলের ছবি রাখা যাবে না– এমনই আপত্তি নাকি জানিয়েছে খোদ মন্দির কমিটি! এই খবর প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছিল তুমুল বিতর্ক। আর সেই বিতর্কের মুখে তারা ক্ষমা চাইলেও যে দাগ ফেলে রেখে গেল এই ঘটনা, তা বেশ উদ্বেগের।
কেন কাজী নজরুল ইসলামের (Kaji Najrul Islam) ছবি থাকবে না অনুষ্ঠান মঞ্চে? সদ্য ‘হেরিটেজ’ আখ্যা পাওয়া এই মন্দিরের কমিটির দাবি ছিল– ভিন্ন ধর্মের কারও ছবি এই মন্দিরের দেওয়ালে রাখা যাবে না। এই দাবি, এই ওজর উঠছে কোথায়? নবদ্বীপে, যেখানে চৈতন্যর হাত ধরে প্রথম ধর্মের অচলায়তন ভেঙেছিল, তৈরি হয়েছিল নতুন এক মুক্তির পরিবহ। যে সংকীর্ণ হিন্দু মন এই নিদান দিল, তা একবারও ভেবে দেখল না, নজরুল যখন শ্যামাসংগীত বা বৈষ্ণব রসের গান লিখেছেন– তখন উদারতা দিয়েই তিনি উত্তর দিয়ে গিয়েছেন এই বিদ্বেষের। তখনও ধর্মীয় অনুশাসনের শিকার হতে হয়েছে ‘বিদ্রোহী কবি’-কে। কিন্তু সেসব পরোয়া না করেই যে সৃষ্টি-আলেখ্য তিনি রেখে গেলেন, তা তো চিরন্তন হল, সেই বিভেদমানস কোথায় জায়গা পেল ইতিহাসে?
[আরও পড়ুন: আধুনিক বিজ্ঞানের সব সূত্র এসেছে বেদ থেকেই! দাবি খোদ ইসরো চেয়ারম্যানের]
মুঘল ইতিহাসের চিহ্ন মোছার জন্য যখন বদলে যাচ্ছে নাম, ইতিহাসের সিলেবাসে আসছে বদল, তখন এই ঘটনা যে বার্তা বহন করছে, তা আদতেই বাঙালির ইতিহাসের কাছে ভয়ের। বেতার থেকে চলচ্চিত্রে সুরযোজনা– সাহিত্যের পাশাপাশি কাজী নজরুল ইসলামের বহুমুখী অবদান খুঁজে পাওয়া যায়, নানা প্রিজমে তাঁকে ভেঙে দেখা যায়। তার বদলে এই জন্মজয়ন্তীতে, তাঁরই নামাঙ্কিত সন্ধ্যায় তাঁকে ‘অচ্ছুত’ হতে হল?
কৃষক-মুক্তির কথা বলতে গিয়ে কাজী নজরুল ডাকছেন ‘বলরাম’-কে, যিনি হিন্দুদের কৃষিসভ্যতার প্রতিভূ, আবার প্রিয় ক্লাব মোহনবাগানের জয়ের পর যে কবিতা লিখছেন, সেখানে আবেগবিহ্বল ‘আল্লাহ হু আকবর’-এর সোচ্চার ঘোষণা। এভাবে যিনি ধর্মের জলে অবিরল সন্তরণে অভ্যস্ত হয়েছেন, বারবার দেওয়াল ভেঙেছেন, হাত বাড়িয়েছেন নতুন আকাশে– তাঁর প্রগতিকে আমরা কতটুকু সম্মান জানাতে পারলাম এত বছর পরে? এই লজ্জা মাথায় রেখেই বলার, আমাদের এই তাৎক্ষণিক কালিমা আবহমানে মুছে যাবে বলেই আশা রাখা যায়, থেকে যাবেন নজরুল। অন্নদাশঙ্কর রায়ের সেই কথাটিই স্মর্তব্য, ‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/ আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে/ ভাগ হয়নিকো নজরুল।’