প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোদিকে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত সংঘেরই নেওয়া। তিনিও সংঘের একাধিক লক্ষ্য বাস্তবায়িত করেছেন। মিডিয়ায় যখন লেখা হত, সংঘ আর বিজেপির চালক নয়, মোদি-ই সংঘ নিয়ন্ত্রক, তখনও তো মোহন ভাগবত ফোঁস করেননি। তাহলে এখন হঠাৎ মোহন-বাঁশি বেজে উঠল কেন? লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
এক সপ্তাহ ধরে চর্চা চলছে আরএসএস সংঘচালক মোহন ভাগবতের বক্তৃতা নিয়ে। কেন তিনি স্বয়ংসেবকদের অহংকারী হওয়া সাজে না বললেন, কেন রাজনৈতিক শিষ্টাচার থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন, বিরোধীরা ‘প্রতিপক্ষ’, কিন্তু ‘শত্রু নয়’ জানিয়ে বললেন– দেশ চালাতে হয় সহমতের ভিত্তিতে। সেসব নিয়ে এখনও বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। মোহন ভাগবত মণিপুর পরিস্থিতি নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করে বোঝাতে চেয়েছেন, একটা রাজ্য এত দিন ধরে জ্বলছে, অথচ সেই আগুন নেভাতে কেন্দ্রীয় সরকার উদ্যোগী হয়নি। প্রত্যেকেই একমত– কারও নাম না-করলেও মোহন ভাগবতের লক্ষ্য ছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী।
নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক আচরণ ও কাজের স্টাইলের সমালোচনা তিনি করেছেন এবং বুঝিয়ে দিয়েছেন, যেভাবে তিনি সরকার চালাচ্ছেন সংঘ অনুমোদিত নয়। তঁাকে স্টাইল বদলাতে হবে। সবাইকে নিয়ে চলতে হবে। নিজেকে সবার চেয়ে আলাদা ও সবকিছুর ঊর্ধ্বে ভাবা বন্ধ করতে হবে। ‘পার্সোনালিটি কাল্ট’ তৈরি করা চলবে না।
সংঘ চালকের ওই ভাষণের পর আরও কয়েকজন প্রকাশ্যে ওই ধরনের মন্তব্য করেছেন। যেমন, সংঘ-ঘনিষ্ঠ রতন সারদা। সংঘ প্রভাবিত ‘অর্গানাইজার’ ম্যাগাজিনে তিনি লেখেন, বিজেপি নেতারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। তঁারা উড়ছিলেন। এই ভোট তঁাদের জমিতে ফিরিয়ে এনেছে। প্রায় একই সময় আরএসএসের আর-এক শীর্ষ কর্তা ইন্দ্রেশ কুমারও জয়পুরে এক অনুষ্ঠানে বলেন, যঁারা উদ্ধত ও অহংকারী,
ভগবান রাম তাঁদের ২৪০-এ থামিয়ে দিয়েছেন।
[আরও পড়ুন: রামমন্দিরে চলল গুলি! মৃত SSF জাওয়ান, অযোধ্যায় ব্যাপক আতঙ্ক]
একের-পর-এক এই সমালোচনার মধ্য দিয়ে পরিষ্কার– সংঘের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদির ব্যাপক খটাখটি চলছে এবং সেটা এখন আর গোপন নয়। প্রকাশ্য সমালোচনার মধ্য দিয়ে সংঘের বার্তা, এবার থেকে মোদি যেন একতরফা কোনও সিদ্ধান্ত আর না নেন। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে যেন সংঘের সঙ্গে আলোচনা করেন। এমনও মনে করা হচ্ছে, এরপর হয়তো আর অনর্থক সংঘাতের রাস্তায় মোদি হঁাটবেন না। সংঘকে উপেক্ষা করবেন না। তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেবেন।
তৃতীয় দফায় সুবোধ বালকের ভূমিকায় তিনি নামবেন কি না, সংঘকে গুরুত্ব দেবেন কি না, গণতন্ত্রী হবেন কি না, সেই আন্দাজ নরেন্দ্র মোদি এখনও দেননি। সদ্য মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন। সাংসদ হিসাবে এখনও কেউ শপথ পর্যন্ত নেননি। সংসদের অধিবেশনও বসেনি। তবু তারই মধ্যে যেটুকু আভাস, তাতে ভোলবদলের খুব একটা ইঙ্গিত কিন্তু নেই। অসামরিক পরিবহণ মন্ত্রক ছাড়া সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ দফতর তিনি দলের দখলে রেখেছেন। লোকসভার স্পিকার পদ শরিকদের ছেড়ে দেওয়ার মতো দরাজ ও দিলখোলা হবেন তেমন ইঙ্গিত দেননি। শরিকদের প্রয়োজনের তুলনায় কিঞ্চিৎ বেশি গুরুত্বও দেননি। বরং দিল্লির উপ-রাজ্যপাল ১৪ বছর আগে অরুন্ধতী রায়দের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া অভিযোগের বিচার ইউএপিএ-তে করানোর অনুমতি দেওয়ায় মনে হচ্ছে, মোদি আদৌ বদলাননি। মুড়ি-মুড়কির মতো ‘রাষ্ট্রদ্রোহ আইন’-এর ব্যবহার যেভাবে
তঁার সরকার এত কাল করে আসছে সেই ধারাবাহিকতাই বজায় রাখতে চাইছেন। মচকানোর অঁাচ কাউকে পেতে দিতে তিনি রাজি নন।
[আরও পড়ুন: ক্যানসারে স্ত্রীর মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান, হাসপাতালেই আত্মঘাতী অসমের স্বরাষ্ট্র সচিব]
নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না-পাওয়া নরেন্দ্র মোদি বদলাবেন কি না, গণতন্ত্রী হবেন কি না, ঐকমত্যের ভিত্তিতে সরকার চালাবেন কি না, সংসদের গরিমা ফেরাবেন কি না– সেসব পরের কথা। তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি মোহন ভাগবত কেন এভাবে হঠাৎ সরকারের সমালোচনা শুরু করলেন!
দশ বছর মোদি যেভাবে চলেছেন, সবার সব আপত্তি দুরমুশ করে যেভাবে স্বৈরতন্ত্রীর মতো দেশ চালিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে কই একবারের জন্যও মোহনবাবুকে গর্জাতে দেখা যায়নি! একবারের জন্যও তো তঁাকে বলতে শোনা যায়নি, ওহে, সংঘের সেবকদের উদ্ধত হতে নেই। অহংকারী হতে নেই। নরেন্দ্র মোদি তো সংঘের মতো দেশেরও সেবক। তিনি নিজেই তো বারবার বলেছেন, আমি প্রধানমন্ত্রী নই, প্রধান সেবক। নানাভাবে বুঝিয়েছেন তিনি সবার উপরে।
মিডিয়ায় যখন লেখা হত, সংঘ আর বিজেপির চালক নয়, মোদি-ই সংঘ নিয়ন্ত্রক, তখনও তো মোহন ভাগবত ফোঁস করেননি। নতুন সংসদ ভবনের শিলান্যাস এবং উদ্বোধনের সময় দুই রাষ্ট্রপতিকে যখন উপেক্ষা করা হয়েছিল, তখন কেন নীরব ছিলেন? ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সরকার প্রধান হয়ে যখন মোদি রামমন্দির উদ্বোধনের মধ্যমণি হন, তখনও তো আদর্শের কথা ভাগবতের মনে পড়েনি। তিনি নিজেও তো সেই অনুষ্ঠানে শরিক হয়েছিলেন। কই, শংকরাচার্যদের মতো নিজেকে তো সরিয়ে রাখেননি। তাহলে এখন
হঠাৎ কেন এত বিপ্লবী সাজা?
[আরও পড়ুন: গুলির লড়াইয়ে ধুন্ধুমার রাজধানী! বার্গার কিং আউটলেটে মৃত এক]
উত্তরটা সহজ। বিজেপির নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা না-পাওয়ার দায় সংঘের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলে ‘মোদি অ্যান্ড কোং’-এর ঘাড়ে চালান করা। আগামী বছর সংঘের শতবর্ষ পূর্তি। এই ১০০ বছর যে-নীতিজ্ঞান, দেশ ও সমাজ গড়ার যে-আদর্শের কথা শুনিয়ে এসেছেন, সর্বার্থে সৎ থাকার যে-ভাবমূর্তি সযত্নে তৈরি করেছেন, তাতে যাতে কালি না লাগে সেই চেষ্টাই তিনি করতে চেয়েছেন। সবাইকে তাই বোঝাতে চাইছেন, মোদির এই আচরণ অসমর্থযোগ্য। অনুমোদনহীন। বিজেপির এই নিম্নমুখিতায় সংঘের কোনও দায় নেই।
ভাবের ঘরে চুরি এটাই। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোদিকে খাড়া করার সিদ্ধান্ত সংঘই নিয়েছিল। সেই মোদি সংঘের একটার পর একটা লক্ষ্য বাস্তবায়িতও করেছেন। সুপ্রিম কোর্টকে দিয়ে অযোধ্যা বিবাদ মিটিয়েছেন।রামমন্দির নির্মাণ করাচ্ছেন। তিন তালাক প্রথা রদ করেছেন। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ করেছেন।
অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রচলনে অর্ধেক পথ এগিয়ে গিয়েছেন। সমাজে হিন্দুত্ববাদ প্রোথিত করেছেন দৃঢ়ভাবে। গণতন্ত্র ও দেশের বৈচিত্রপূর্ণ ঐতিহ্যনষ্ট করেছেন। কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছেন।
সবকিছু করেছেন নিজস্ব ঢঙে, ঔদ্ধত্যপূর্ণ স্টাইলে, গণতান্ত্রিকতার ধার না-ঘেঁষে। ঐকমত্যের ধারকাছ দিয়েও মোদি দশ বছর হাঁটেননি! অথচ একবারও মোহন-বাঁশি বাজেনি! কেন?
কারণ, মোদি ফল দিচ্ছিলেন। সংঘের লক্ষ্যপূরণ হচ্ছিল। কীভাবে তা করছেন বিবেচিত হয়নি। এখন যেইদেখা গেল ৪০০ পারের স্লোগান ২৪০-এ থেমে গেল, তখন মোহন ভাগবতের কাছে মোদি রাতারাতি হয়ে উঠলেন ‘ভিলেন অফ দ্য পিস’। আমি নিশ্চিত, এবারও মোদির বিজেপি ৩০০ ছুঁয়ে ফেললে ভাগবত বিপ্লবী সাজার কথা কল্পনাও করতেন না। নীরবে হজম করতেন সব ঔদ্ধত্য ও অহংকার, ঠিক যেভাবে এতগুলো বছর মাথা নিচু করে মেনে এসেছেন।
[আরও পড়ুন: ফের প্রকাশ্যে কানাডার খালিস্তান প্রেম, জঙ্গি নিজ্জরের জন্য নীরবতা পালন সংসদে!]
সংঘ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, বিজেপি রাজনৈতিক। এই বিভাজন আরোপিত এবং পুরোপুরি অসত্য। বিজেপির রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সংঘ মাথা ঘামায় না, এই দাবির মতো মিথ্যাও আর কিছু হয় না। বস্তুত, সংঘ ও বিজেপি একে-অপরের পরিপূরকই শুধু নয়, একজন ছাড়া অন্যজনের অস্তিত্বও বিপন্ন হতে বাধ্য। দু’টিই অভিন্ন। বিজেপিতে তাই সংঘের দাপট চিরন্তন। সংগঠন হোক কিংবা সরকার, মন্ত্রী-সান্ত্রী কিংবা রাজ্যপাল, বিজেপিতে সংঘের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত মানুষজনের উপস্থিতি চিরকাল।
সংঘ যাদের সঙ্গে নীতি ও আদর্শগত লড়াই চালিয়ে আসছে, তারা কমিউনিস্ট ও কংগ্রেস। কংগ্রেসের সেই দলছুটরা বিজেপিতে কলকে পেলে সংঘের ক্ষুব্ধ হওয়ারই কথা। রতন সারদা তঁার নিবন্ধে সরাসরি সে-কথা লিখেওছেন। কিন্তু কখন তিনি লিখলেন? কখন ভাগবত ফোঁস করলেন? দলছুট কংগ্রেসিদের প্রশ্রয় দিয়ে অসম-সহ গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চল মোদি যখন তালুবন্দি করছেন, তখন নয়। অনৈতিকভাবে মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ঝোলায় পুরছেন, তখনও নয়। পাঞ্জাবে পায়ের তলায় জমি পাওয়ার চেষ্টা করেছেন অথবা পশ্চিমবঙ্গে দঁাত ফুটিয়েছেন তখনও নীরব দর্শক। মোহন ভাগবতের বিবেক জাগ্রত হয়নি। কোণঠাসা নরেন্দ্র মোদি শোধরাবেন কি না পরের কথা। তবে সংঘ পিঠ বঁাচাতে চাইছে। তাদের এই ভণ্ডামি মানুষ
ধরে ফেলেছে।