কোন বিচারবুদ্ধি থেকে প্রধানমন্ত্রী তাঁর থেকে ১৮৭ বছরের বড় ‘বঙ্কিমচন্দ্র’-কে ‘বঙ্কিমদা’ বলে বসলেন, তা অনুমান করা সত্যিই দুঃসাধ্য।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কারও কারও, তাঁর নিজের পদমর্যাদার প্রাবল্যে তাঁর আপন অজ্ঞতার উৎসাহে, ‘দা’ বলতে ইচ্ছা করতেই পারে। কিন্তু কোনও হিতাহিত জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ তা কি করবেন? বিশেষ করে লোকসভার ভাষণে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রকে ‘দা’ সম্ভাষণ? সেই কর্মটি করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি! তিনি চারবার তাঁর ভাষণে ‘বন্দে মাতরম’-এর রচয়িতাকে ‘বঙ্কিমদা’ বলেছেন। হয়তো ভুলে গিয়েছেন বঙ্কিম তাঁর থেকে আর কিছুতে বড় হোন না হোন, বয়সে অন্তত অনেক বড়। ১৮৭ বছরের মানুষকে বাংলা ভাষায় অন্তত ‘দা’ সম্ভাষণ করা চলে না। বঙ্কিম-ফেলুদা, টেনিদা, ঘনাদা নন, যে চিরকালের ‘দা’ হয়ে থাকবেন বাঙালির সাহিত্যে ও মনে।
সমস্যা হল বাংলা সংস্কৃতি ও ভাষার চরিত্র ও নিজস্ব ‘হায়ারার্কি’ বা শ্রেণিক্রম। সেখানেই নিহিত একটি শ্রেণিকাঠামো। পদমর্যাদার স্তর-সমন্বিত এই সংগঠন থেকে বেরিয়ে এসে যে-মুহূর্তে মোদি বারবার বঙ্কিমচন্দ্রকে ‘দা’ সম্বোধন করেছেন, ততবার তিনি বাঙালি সংস্কৃতি, ভাষা ও জাতীয় সম্মানের ও অভিমানের শিকড়ে ‘দা’ মেরেছেন। বাঙালির মনে ও আত্মসম্মানে ঘটিয়েছেন রক্তপাত। কোনও বাঙালি বঙ্কিমচন্দ্রকে বঙ্কিমবাবু বলতেই পারেন।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে রবিবাবু! ঈশ্বরচন্দ্রকে ঈশ্বরবাবু! অসম্ভব! বাংলা ভাষার নিজস্ব চলতি ভদ্রতা এমন ধৃষ্ট সম্ভাষণের পথ আগলে দাঁড়াবেই। কোনও অবাঙালির পক্ষে বাংলা ভাষার এই গূঢ় চরিত্র এবং চলন হয়তো বুঝে ওঠা অসম্ভব। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যা করলেন, তা কি তাঁর সচেতন তাচ্ছিল্য নয় এক অবিস্মরণীয় বাঙালি ‘আইকন’-এর প্রতি? তার কারণ, শুধু তো প্রধানমন্ত্রী নন, কেন্দ্রীয় সংস্কৃতিমন্ত্রী গজেন্দ্র সিংহ শেখাওয়াত বন্দে মাতরম নিয়ে আলোচনায় ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ উচ্চারণে বারবার ঠোক্কর খেলেন। শেষ পর্যন্ত পৌঁছলেন, ‘বঙ্কিমদাস চ্যাটার্জিতে!’
বারবার ‘বঙ্কিমদা’ বলার ভ্রান্তিবিলাসে এতটুকু লজ্জা না পেয়ে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে আরও বাজারি আবেগ আনতে চলে গেলেন হঠাৎ স্বাধীনতা আন্দোলনে সূর্য সেন প্রসঙ্গে। এবং তাঁকে ‘মাস্টারদা’ না বলে বললেন শুধু ‘মাস্টার’। এরপর আরও এক গাড্ডা! স্বাধীনতা সংগ্রামের বিখ্যাত বাঙালি পুলিনবিহারী দাসকে তিনি অবলীলায় ডাকলেন ‘পুলিনবিকাশ দাস’। এবং তিনি এই কীর্তিলহরী রেখে গেলেন তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়ের সোচ্চার প্রতিবাদে কর্ণপাত না করে!
প্রধানমন্ত্রী ব্যস্ত মানুষ। তিনি নাই জানতে পারেন ভারতের এক-এক অঞ্চলের ভাষা ও সংস্কৃতি। কিন্তু ‘বন্দে মাতরম’-এর মতো বিষয়ে মুখ খোলার আগে উপযুক্ত ভাষায় ও বক্তব্যে তৈরি হয়ে আসেননি? একটা সহজ কথা শেষে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে শুধু ‘রবীন্দ্রনাথ’, বা ‘বঙ্কিমচন্দ্র’-কেও পদবি থেকে ছাড়িয়ে শুধুই তাঁর নাম ব্যবহার করলে, বাংলা ভাষা ও বাঙালি কোনও দোষ দেখে না। তাঁরা ছাড়িয়ে উঠেছেন তাঁদের পদবির পরিচয়!
