শুরু মোদির ৩.০ ইনিংস। সবাইকে নিয়ে চলার কথা দশ বছরে তিনি বহুবার বলেছেন। অথচ, এই প্রথম কেন্দ্রীয় সরকার পুরোপুরি মুসলমান বর্জিত। ভোটের ফলপ্রকাশ থেকে সংসদে শপথগ্রহণ পর্যন্ত যা যা ঘটে গেল, তাতে চোখ বোলালে স্পষ্ট বোঝা যায়, যে ঢংয়ে এত কাল তিনি হেঁটে এসেছেন, সেই ছন্দেই হাঁটবেন। লিখছেন সৌম্য বন্দে্যাপাধ্যায়।
সাধারণ মানুষকে বশীভূত করার অদ্ভুত ক্ষমতা নরেন্দ্র মোদির আছে। তিনি নিজে যেটা ঠিক মনে করেন, অন্যদেরও তা ঠিক বলে বুঝিয়ে দেন। সবার এই ক্ষমতা থাকে না। কিন্তু তাঁর আছে। আছে বলেই আদর্শ উন্নয়ন হিসাবে ‘গুজরাত মডেল’-কে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। তারপর যখন মানুষ বুঝতে পারে, ওই মডেল নিছক পুঁজিবাদী তোষণ ও এক বিরাট ভাঁওতা, তখন তা নিয়ে আর তিনি উচ্চবাচ্য করেন না। অন্য একটা কিছু খাড়া করে দেন।
বারবার লক্ষ্য বদলানোর খেলাতেও তিনি ওস্তাদ। যেমন, শুরু করেছিলেন ‘অচ্ছে দিন’-এর স্বপ্ন দেখিয়ে। তা এল কি এল না বয়েই গেল, তারই মধ্যে বাজারে ছেড়ে দিলেন ‘বিকশিত ভারত’-এর স্লোগান। সেই ভারত চাক্ষুষ করতে গেলে ২০৪৭ পর্যন্ত বেঁচেবর্তে থাকতে হয়। তত দিনে বহুবার স্লোগান পাল্টে যাবে। বছরে ২ কোটি চাকরি, কৃষকদের দ্বিগুণ আয়ের গালভরা বুলি গিলে এখন ভাসিয়েছেন পাঁচ ট্রিলিয়ন অর্থনীতির খোয়াব। অলীক স্বপ্নজাল বুনতেও তিনি অনন্য।
[আরও পড়ুন: উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া নয়, সভাপতি নির্বাচনের আগে নিচুতলার পরামর্শ চায় বিজেপি]
আরও এক বিরাট যোগ্যতার অধিকারী তিনি। অবলীলায় এমন অসত্য ভাষণ দেবেন যে, মনে হবে ওটাই সারসত্য। এবার ভোটে কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তেহার নিয়ে যা বলেছেন, ইতিহাস ঘেঁটে তেমন মিথ্যাচারের দ্বিতীয় উদাহরণ পাওয়া যাবে না। সবাইকে নিয়ে চলার কথা দশ বছরে তিনি দশ হাজার বার বলেছেন। অথচ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য। তাঁর মতো ভোটব্যাঙ্ক পলিটিক্সের ট্রিক আর কেউ আয়ত্ত করেনি। তঁার অভিধানে ‘মুসলমান’ শব্দটিই নেই! তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এবারের সরকার। স্বাধীনতার অমৃতকালে এই প্রথম কেন্দ্রীয় সরকার পুরোপুরি মুসলমান-বর্জিত। কিন্তু তা সত্ত্বেও অবলীলায় সবাইকে নিয়ে চলার, সবার বিশ্বাস অর্জনের দাবি জানান। বিদেশিরা এ নিয়ে কটাক্ষ করলে তিনি বলেন, ভারত সম্পর্কে তাদের সম্যক ধারণাই নেই। তাদের বিরুদ্ধে অসত্য প্রচারের অভিযোগ আনেন। এখনও পর্যন্ত কেউ তঁাকে কোনও অপরাধবোধে ভুগতে দেখেনি। ক্ষমাপ্রার্থীও হননি। বরং বুক ফুলিয়ে জাহির করেছেন, যা করছেন ঠিক করছেন। এটাই তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
এই বৈশিষ্ট্য তিনি হুট করে অর্জন করেননি। রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে কীভাবে এই ক্ষমতা আয়ত্ত করেছেন তা গুজরাতের প্রবীণ ও বিজ্ঞজনেরা জানেন। অদ্ভুত সব নাটকীয় মুহূর্ত তৈরির অননুকরণীয় ক্ষমতারও অধিকারী তিনি। শ্রদ্ধাবনত হয়েও কীভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করা যায় তা তঁাকে
দেখে শিখতে হবে। সংসদের সিঁড়িতে এমনভাবে মাথা ঠোকেন যে, মনে হয় বিশ্বের সেরা
গণতন্ত্রী তিনিই।
অথচ প্রতিটি সাংবিধানিক রীতি, প্রথা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পায়ে দলে চলেছেন। গড়ে তুলেছেন এক স্বকীয় স্বতন্ত্র শাসনরীতি। গণতন্ত্রে ‘বিরোধী’ ভূমিকার প্রয়োজনীয়তার কথা বলবেন, অথচ পাইকারি হারে সদস্যদের সাসপেন্ড করে গুরুত্বপূর্ণ বিল পাস করাবেন। ইন্দিরা গান্ধী ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করেছিলেন। কিন্তু প্রত্যাহারের পর দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন। ক্ষমা চেয়েছিলেন। ওই সিদ্ধান্ত থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা বলেছিলেন। নরেন্দ্র মোদি অঘোষিত ‘জরুরি অবস্থা’ জারির জন্য ধিকৃত। সমালোচিত। নিত্য নিন্দিত। কিন্তু দুঃখপ্রকাশ বা ক্ষমা প্রার্থনার ধারকাছ দিয়েও হাঁটতে শেখেননি।
[আরও পড়ুন: ‘আরও কাছাকাছি…’, হাতে হাত, আলিঙ্গন! সংসদে ক্যামেরাবন্দি কঙ্গনা-চিরাগের ‘ব্লকবাস্টার’ দৃশ্য]
সেই তিনি রাজনৈতিক জীবনের প্রথম মোক্ষম হোঁচট খাওয়ার পর যখন ঐকমত্যের কথা, সহমতের কথা, সংবিধান ও সাংবিধানিক রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার কথা, সবাইকে নিয়ে চলার কথা, সবার বিশ্বাস অর্জনের কথা বড় মুখ করে বলেন, তখন অতি পরিচিত ইংরেজি বুলি মনে পড়ে যায়, ‘আ লেপার্ড নেভার চেঞ্জেস ইট্স স্পটস’। ইদানীং বিষয়টি এতই প্রকট যে তাঁর হাল ওই ‘হংস মধ্যে বক যথা’। ভুলেই গিয়েছেন, ছাই মাখলেই সন্ন্যাসী হওয়া যায় না। কথায় বলে, স্বভাব যায় না মলে, ইল্লত (মলিনতা) যায় না ধুলে। খুবই সত্যি এই আপ্তবাক্য। যারা ভাবছে, ঠেলায় পড়ে এবার তিনি শুধরে যাবেন, অচিরেই তারা বোকা বনবে। ভোটের ফলপ্রকাশ থেকে সংসদে শপথগ্রহণ পর্যন্ত যা যা ঘটে গেল, তাতে চোখ বোলালে সেই পুরনো প্যাটার্ন ও স্টাইলই নজরে পড়বে। স্পষ্ট বোঝা যায়, যে-ঢংয়ে এত কাল তিনি হেঁটে এসেছেন সেই ছন্দেই হঁাটবেন। বিচ্যুতি ঘটবে না বিন্দুমাত্র।
মন্ত্রক বণ্টন থেকেই শুরু করা যাক। যারা ভেবেছিল, শরিক নির্ভর হয়ে যাওয়া মোদির হাল হবে ‘ফান্দে পড়িয়া বগা’-র কান্নার মতো, ঘনঘন হাত কচলাবেন, বাবা-বাছা করবেন, কর্ণর মতো দাতার ভূমিকায় নামবেন, অচিরেই তারা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ‘বিগ ফোর’ মন্ত্রক তো বটেই, প্রায় সব গুরুত্বপুর্ণ দফতরই তিনি পার্টির হাতে রাখতে পেরেছেন। শুধু তা-ই নয়, যে-যেখানে ছিলেন সেখানেই থেকে গিয়েছেন। ব্যতিক্রম শুধু অসামরিক পরিবহণ মন্ত্রক। সেটুকু করেছেন চন্দ্রবাবু নাইডুকে ‘গুড হিউমার’-এ রাখার জন্য। রাজনীতির চাল।
মন্ত্রিসভা গড়ার পরের ধাপ স্পিকার নির্বাচন। কিন্তু তার আগে এমন একটা সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে যা বুঝিয়ে দেয় কিছুটা দুবলা হলেও তেজ ও পুরনো মেজাজ তঁার একইরকম আছে। মনোভাব বিন্দুমাত্র বদলায়নি। বদলালে অরুন্ধতী রায়ের বিরুদ্ধে ‘কালা কানুন’ ইউএপিএ-তে মামলা রুজুর সিদ্ধান্ত নিতেন না। যে অভিযোগ চোদ্দো বছর পুরনো, তামাদি হয়ে যাওয়া বিস্মৃতপ্রায় সেই বিষয়কে খুঁচিয়ে তোলার মধ্য দিয়ে বেশ বোঝা যায় মেজাজটাই আসল রাজা। দশ বছর ধরে যে ভাবনা তিনি ভেবে এসেছেন, যে আচরণ করে এসেছেন, যাবতীয় বিরোধিতা দুরমুশ করেছেন, তা থেকে সরে আসার মানুষ তিনি নন। কথাতেই আছে, মরলেও স্বভাব বদলায় না।
[আরও পড়ুন: ‘সংবিধান নিয়ে ড্রামার জবাব দেবে এমার্জেন্সি’, ফের রণংদেহী কঙ্গনা]
লোকসভায় শপথ নেওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী সহমতের কথা, সংবিধান রক্ষার কথা ঘটা করে শুনিয়ে দিয়েছেন। অথচ, প্রোটেম স্পিকার মনোনীত করলেন আটবারের সদস্যকে সুরেশের বদলে সাতবারের সাংসদ ভর্তৃহরি মহতাবকে। সুরেশকে বেছে নিলে তঁার গরিমা বাড়ত বই কমত না। সহমতের রাস্তায় হাঁটতে তিনি যে পা বাড়িয়ে আছেন, তা-ও বোঝাতে পারতেন। কিন্তু তা না করে বোঝালেন, বিন্দুমাত্র বাড়তি ঢিলেমি দিতে এখনও তিনি প্রস্তুত নন।
স্পিকার পদে তাঁর রত্ন ওম বিড়লা নিশ্চিত। ডেপুটি স্পিকারের বিরোধী শর্ত মানতে তিনি নারাজ। প্রয়োজনে ভোটাভুটি সই, কিন্তু কারও চাপে মাথা নোয়াতে তিনি রাজি নন। সেটা তাঁর চরিত্রবিরোধী। পাঁচ বছর লোকসভা চালিয়েছেন ডেপুটি স্পিকার ছাড়াই। এবার হয়তো তা করবেন না, পদটা হয়তো শরিকদের কাউকে দেবেন, কিন্তু বিরোধীদের চোখরাঙানি সইবেন না।
গত দশ বছরে গুরুত্বপূর্ণ কোনও বিতর্কে তিনি মুখ খোলেননি। মনমোহন সিং-কে দেওয়া ‘মৌনমোহন’ বিশেষণ তাঁকেই মানায়। ‘মৌনমোদি’। কৃষক আন্দোলন নিয়ে রা কাড়েননি। মণিপুর নিয়ে এখনও নির্বাক। সর্বভারতীয় পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে সারা দেশ তোলপাড়, তাঁর মুখে কুলুপ। অথচ ঘটা করে ‘পরীক্ষা পে চর্চা’ শুরু করেছিলেন! আজকের নীরবতা বুঝিয়ে দিচ্ছে আদতেই তিনি পরিবর্তনকামী নন। তা সে চরিত্র, আচরণ বা নীতি যাই হোক না।
[আরও পড়ুন: পুরুষরা সাবধান! বদলা নিতে আসছে ‘স্ত্রী’, টিজারেই শিহরণ]
দশ বছর ধরে যিনি সাংবাদিক সম্মেলন করেননি, সংসদে কোনও প্রশ্নের জবাব দেননি, মুলতবি প্রস্তাব গ্রহণে সম্মত হননি, বিরোধীদের কণামাত্র গুরুত্ব দেননি, এবার লোকসভায় শপথগ্রহণের পর প্রথামাফিক বিরোধীদের কাছে গিয়ে অভিনন্দন পর্যন্ত জানালেন না, তিনি স্রেফ ৩২টা আসন কম পেয়েছেন বলে ভোল বদলে ফেলবেন এমন বান্দা নরেন্দ্র মোদি নন। তিনি তাঁর মতোই থাকবেন। বদল ঘটার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে বছরশেষে। মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা বিজেপির হাতছাড়া হলে, ঝাড়খণ্ডে ফের ‘ইন্ডিয়া’ ক্ষমতায় এলে, সে হবে অন্য কাহিনি। তার আগে যথা ‘পূর্বং তথা পরং’।