আদিত্য ঘোষ: ভূত কিনবেন? লাখ টাকা খরচ করলেই পেয়ে যাবেন একখানা ভূত! তাকে আপনি সঙ্গে রাখতে পারবেন। আপনি যা বলবেন সে তাই করবে। কাউকে চমকাতে বা ভয় দেখাতে পারবেন। ধরুন, আপনার উপর কেউ বেশি কথা বলছে, বা আপনার কর্মক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কেউ আপনাকে প্রতিনিয়ত অপদস্ত করছে– তার পিছনে সহজেই লেলিয়ে দিতে পারবেন ভূতকে।
কলিযুগে যখন ‘এআই’ প্রায় সারা পৃথিবীব্যাপী রাজত্ব কায়েম করছে। সেই মাহেন্দ্রক্ষণে ভূত, প্রেত, পিশাচ নিয়ে মাতামাতি করছি আমরা। ভূতকে ক্ষমতায়নের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছি। ভূতের বাণিজ্যিকীকরণ ঘটিয়ে ফেলেছি বহু আগেই। তার প্রথম ধাপ হিসাবে পণ্যের মার্কেটিং করতে হয়। তারপর ক্রেতা ধরতে হয়। শেষে আসে বিক্রির বিষয়টা।
ভূতদের নিয়ে এই প্রক্রিয়াটাই চলছে রমরমিয়ে। যেভাবে লিখেছি– ঠিক সেভাবেই ভূতের কেনাবেচা চলছে। সমাজমাধ্যমের দৌলতে সহজেই মার্কেটিং সারা যাচ্ছে। একটু খোঁজ রাখলে পেয়ে যেতে পারেন– ভূত বিক্রির ঠিকানা। অলৌকিক বিষয়ের সঙ্গে তন্ত্রের সরাসরি কোনও সম্পর্ক নেই– তবুও তন্ত্রকে এমন একটি পরিসরে নামিয়ে আনা হয়েছে, যেখানে ‘তন্ত্র’ মানেই ভয় এবং ভীতি প্রদর্শন। অথচ তন্ত্রের আসল মাহাত্ম্য আমরা ভুলতে বসেছি। যে-সময়ে সারা দুনিয়ার চাকা গড়াচ্ছে সামনের দিকে, আমরা তখন ক্রমশ পিছিয়ে আসছি। আলো ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসছে।
‘তন্যতে বিস্তার্যতে জ্ঞানম্ অনেন ইতি তন্ত্রম’, অর্থাৎ যে-শাস্ত্রের দ্বারা জ্ঞান বৃদ্ধি পায়, তাকে ‘তন্ত্র’ বলে। তন্ত্র হচ্ছে বেদান্ত ও সাংখ্যের অতীন্দ্রিয় বিজ্ঞানের সমন্বয়। তন্ত্র প্রথম বলেন শিব, তাঁর কাছ থেকে পরম্পরায় তা চলে আসছে। তন্ত্র ছিল মুক্তির পথ। মন এবং দেহের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা এক নৈসর্গিক যাত্রা। সেখানে ভূত, প্রেত, পিশাচ, কালাজাদু ইত্যাদি ছিল একেবারে নিন্মস্তরের বিষয়। সময় বদলেছে, আমরা ক্রমশ ঢুকে পড়েছি এক আজব দুনিয়ায়। যেখানে ভাল থাকতে আমাদের ভরসা করতে হয় বিশেষ কোনও পাথর, পেনডেন্ট, তাবিজ, মাদুলির উপর। ‘নেগেটিভিটি’ কাটাতে শুনছি বিভিন্ন টোটকা। ব্যাঙের ছালে প্রেমিকের নাম লিখে রাখলে কী হবে, আবার তেজপাতায় ১০৮ বার অমুক মন্ত্র লিখলে কী-কী হতে পারে, এই নিয়েই দিন কাটছে আমাদের।
পডকাস্টে তন্ত্র এবং ভূতদের নিয়ে উৎসব চলছে বারো মাস। এই উৎসবকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিরাট একটা বাজার। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ভারতের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক পণ্যের বাজারমূল্য এখন প্রায় ৫.৫ লাখ কোটি, যা ২০৩৩ সালের মধ্যে বেড়ে ১১.৫ লাখ কোটি ছাড়াবে বলে অনুমান। এর ভিতরই লুকিয়ে আছে তন্ত্র ও মন্ত্রচর্চার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন ব্যবসা– যেমন: তাবিজ, পেনডেন্ট, যজ্ঞ সামগ্রী থেকে শুরু করে অনলাইনে কালাজাদু ছাড়ানো, বাড়ির ‘নেগেটিভ এনার্জি’ দূর করা, ভাঙা সম্পর্ক জুড়ে দেওয়া ইত্যাদি। হোয়াটসঅ্যাপে একটি ছবি এবং উপযুক্ত দক্ষিণা পাঠালেই নিমেষে হয়ে যাচ্ছে তান্ত্রিক ক্রিয়া। বেকার যুবক চাকরির আশায় পরে নিচ্ছে বহুমূল্য তাবিজ।
বাড়ির বাস্তুর সমস্যা ঠিক হয়ে যাচ্ছে হাজার-হাজার টাকার যজ্ঞে। নিঃসন্তান দম্পতি, সদ্য রিলিজ হওয়া সিনেমার নায়ক, নতুন লেখা উপন্যাসের লেখক, রাজনৈতিক নেতা– প্রত্যেকের অগাধ বিশ্বাস এই আজব দুনিয়ার প্রতি। সবটাই চলছে বিশ্বাসে ভিত্তি করে। একটি সমীক্ষা বলছে, ভারতে তৈরি হওয়া মোট পডকাস্টের ২৫% শতাংশই এখন তন্ত্র-ভিত্তিক। সেখানে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে আধ্যাত্মিকতা এবং ধর্মের কিছু অংশ। প্রায় ৭৪% ভারতীয় মনে করে, জীবনের ঘটনাগুলোর পিছনে কোনও না কোনও অতিপ্রাকৃত শক্তি কাজ করে। প্রায় ৪০% মানুষ সরাসরি বিশ্বাস করে কালাজাদু সত্যি। তন্ত্র, জ্যোতিষকে ঘিরে নিত্যনতুন অ্যাপলিকেশন তৈরি হচ্ছে ভারতে। তৈরি হচ্ছে স্টার্ট-আপ। ভারতে বর্তমানে ৯৫০টিরও বেশি আধ্যাত্মিক টেক স্টার্ট-আপ কার্যক্রম চালাচ্ছে, যা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পুজো দেওয়া, পণ্য বিক্রি এবং আধ্যাত্মিক পরামর্শ প্রদান করে। এই খাতে ২০২৪ সালে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এসেছে এবং খাতটি ১০% বার্ষিক বৃদ্ধির হার ধরে ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে।
‘দশমমহাবিদ্যা’ কী এবং কেন, সেটা নিয়ে গত পাঁচ বছরে অন্তত কয়েক লাখ ভিডিও বানানো হয়েছে। যদিও সমীক্ষা বলছে দশমমহাবিদ্যা নিয়ে মানুষের আগ্রহ অন্য জায়গায়। মূল বিষয়ের চেয়ে মানুষের আগ্রহ তন্ত্রের নিন্মগামী প্রয়োগের দিকে। অর্থাৎ বাণমারা, প্রেত চালান, ইত্যাদি বিষয়ে মানুষের আগ্রহ বেশি। কারণ এক শ্রেণির মানুষ প্রাত্যহিক ক্লান্তি, হতাশা থেকে মুক্তি চাইছে। আইনের উপর থেকে বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। তাই ক্রমশ তারা ঝুঁকে পড়ছে অন্ধকারময় দুনিয়ার দিকে। যেখানে বারবার বলা হচ্ছে ধর্মই আমাদের ভিত্তি। আধ্যাত্মিকতাতেই আমার মুক্তি। সারা বিশ্বের মধ্যে ভারতই একমাত্র দেশ যেখানে সবচেয়ে বেশি তন্ত্র, ভূত, প্রেত, জ্যোতিষচর্চা হয়।
সারা বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ধরনের রিল্স, ভিডিও, পডকাস্ট তৈরি হয়। সেই ভিডিও কনটেন্টের প্রায় ১% জ্যোতিষ, তন্ত্র, ভূত, বাস্তু ইত্যাদির কথা বলে। সেখানে আমাদের দেশে দিনে অন্তত ১০টি করে নতুন ভিডিও, পডকাস্ট, রিল্স তৈরি হচ্ছে যা তন্ত্র-ভিত্তিক। পডকাস্টে এসে বিভিন্ন লোকে বিভিন্ন কথা বলছেন। কেউ ইতিহাস বিকৃত করছেন, আবার কেউ ধর্ম। বারবার করে বিশ্বাস করানো হচ্ছে, আমাদের মূল ভিত্তি ধর্ম। সেই ধর্মকে রক্ষা করতে হবে। ধর্মরক্ষার সূচনা করতে হবে নিজেকে হিন্দু প্রমাণ করে। যা আদতে হিন্দু রাষ্ট্র তৈরির প্রথম ধাপ। যখন বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলো আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে জীবনকে আরও সহজতর করছে, তখন আমরা ধর্মের নামে রাজনীতি, রাজনীতির নামে ধর্মকে ব্যবহার করছি। তন্ত্রের সীমাবদ্ধতাকে না-জেনে সেই নিয়ে ব্যবসায় নেমে পড়ছি। ভারতে ভুয়া তান্ত্রিকদের প্রতারণার কারণে ক্রমবর্ধমান আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতি হচ্ছে।
২০২৫ সালে শুধুমাত্র আহমেদাবাদ, ভোপাল ও মুম্বইয়ে তিনটি বড় মামলায় সাধারণ মানুষরা ‘ব্ল্যাক ম্যাজিক’-এর ভয়ে মোট ৫৭.৬৫ লাখ হারিয়েছে। একই বছরে বিকানের, মুম্বই ও রাজস্থানে ভুয়া তান্ত্রিকদের ফাঁদে পড়ে তিনজনের মৃত্যু, একজনের গুরুতর আহত, এবং একটি শিশুহত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের ঘটনা সমাজে কুসংস্কার ও অশিক্ষার প্রভাবকে আরও বাড়িয়ে তুলবে, সন্দেহ নেই।
