মন্দির নির্মাণ স্রেফ ‘চমক’ নয়। বিষয়টা আরও গভীর, চমকের থেকেও বেশি কিছু। সেই ইঙ্গিত মুখ্যমন্ত্রীর কথাতেও আছে। জয়নগরের সভা থেকে তাঁর তীক্ষ্ণ মন্তব্য, ‘আর যেন কোনও কাজ নেই! একটাই কাজ!’ কলমে অরূপ কর
রামমন্দির নির্মাণ স্রেফ ‘গিমিক’, ‘ভোটের চমক’! প্রকাশ্য সভা থেকে এভাবেই অযোধ্যা নিয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২২ জানুয়ারি যখন মন্দির নগরীতে ধুমধাম করে, মহাড়ম্বরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিগ্রহে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করবেন, এখনও না পেলেও সেখানে হাজির থাকার আমন্ত্রণ পেয়েও তিনি এই কঠোর মনোভাব বহাল রেখে হয়তো যাবেনও না। এভাবেই একটা বার্তা দিতে চাইবেন সংখ্যালঘুদের।
‘গিমিক’ শব্দের আভিধানিক অর্থ, প্রতারণাপূর্ণ কৌশল, জনপ্রিয়তা লাভের বা মনোযোগ আকর্ষণের জন্য উপায় বা কৌশল। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, এটা বিজেপির ‘নির্বাচনী চমক প্রদর্শনী’। কিন্তু এটা কি স্রেফ চমক? তার বেশি কিছু নয়? কোনও দল ক্ষমতায় বসে কর্মসংস্থান, অনুদানের প্রাক-নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি কাজে করে না দেখালে বলা যেতে পারে, ওটা লোকদেখানো, চমক ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন।
বিজেপির ঘোষিত কর্মসূচিতেই রামমন্দির তৈরির কথা ছিল এবং সুপ্রিম কোর্টের সম্মতি, অনুমোদনক্রমেই কোটি কোটি টাকার রাজসূয় যজ্ঞ চলছে মন্দির নির্মাণে। গেরুয়া শিবির তো যুক্তি দেখাতেই পারে, জম্মু-কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা বাতিল, তিন তালাক নিষিদ্ধ করার মতোই আরেকটা ঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এতে দোষ, অন্যায় কোথায়? চমক কীসের? ভোটারদের দেওয়া প্রতিশ্রুতির খেলাপ তো করিনি! তিন তালাক চালু করে অসহায় মুসলিম মহিলাদের চোখের জল মুছে দেওয়া হয়েছে, ৩৭০ এর অবলুপ্তি ঘটিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কব্জা মুক্ত করে দেশের মূলস্রোতে সামিল করা হয়েছে জম্মু-কাশ্মীরকে, মন্দির গড়ে রামভক্তদের বহুদিনের পুরানো বাসনা পূরণ হয়েছে।
[আরও পড়ুন: আজও ধর্মের কল বাতাসে নড়ে! বিলকিস রায় ভরসা জোগাবে নির্যাতিতাদের]
সুতরাং মন্দির নির্মাণ স্রেফ ‘চমক’ নয়। বিষয়টা আরও গভীর, চমকের থেকেও বেশি কিছু। সেই ইঙ্গিত মুখ্যমন্ত্রীর কথাতেও আছে। জয়নগরের সভা থেকে তাঁর তীক্ষ্ণ মন্তব্য, ‘আর যেন কোনও কাজ নেই! একটাই কাজ!’
‘এই আর কোনও কাজ নেই’– মানুষের মনে এই ধারণা গেঁথে দিতেই এত উদ্যোগ মোদি সরকারের। এত প্রচার। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণকে ভাবতে বিশ্বাস করানো যে, চাকরি, কর্মসংস্থান, বেকারি, গরিবি, অপুষ্টি, নিরক্ষরতা থাকুক, কিন্তু তার আগে চাই মন্দির। মোদির মধ্যে এমন এক নেতা পাওয়া গিয়েছে যিনি পারেন রামের জন্মভূমিতে মন্দির তৈরি করতে। হ্যাঁ, একমাত্র তিনিই পারেন। ‘মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়।’ আজও প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, দেশের স্বাধীনতার শততম বর্ষপূর্তিতে ভারতকে উন্নত দেশ করে তোলার লক্ষ্য নিয়ে এগচ্ছি। আগামী ২৫টা বছর তাই ভারতের অমৃতকাল হবে।
কিন্তু বাস্তব চিত্র কী বলছে? দেশের উত্তরপূর্বের সাত বোনের একটি মণিপুর টানা কয়েক মাস ধরে ধিকিধিকি অশান্তির আগুনে জ্বলছে। সেখানে ক্ষমতায় বিজেপি। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেরাজ্যে প্রধানমন্ত্রী গেলেন না। উত্তরপ্রদেশ-সহ হিন্দি বলয়ের নানা রাজ্যে মহিলা নিগ্রহ, দলিত নিগ্রহ রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিযুক্তদের গেরুয়া শিবিরের সঙ্গে যোগসাজশের ছবি সামনে এসেছে। বিদেশের মাটিতে দেশের মুখ উজ্জ্বল করা মহিলা কুস্তিগীররা শাসকদল ঘনিষ্ঠ সাংসদের যৌন নিগ্রহের শিকার হয়ে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দেখিয়ে সুবিচার পান না, উল্টে তাঁদের দিকেই পাল্টা আঙুল তোলা হয়, পুলিশ চুলের মুঠি ধরে তাঁদের টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। বিলকিস বানোর ধর্ষণকারীরা ‘সংস্কারী’ সার্টিফিকেট পেয়ে জেলের বাইরে বেরিয়ে আসে। আর এই অস্বস্তিকর ছবি থেকে নজর ঘোরাতেই মন্দির-মন্দির করে এত প্রচার। পাশাপাশি জিইয়ে রাখা হয়েছে মথুরা-জ্ঞানবাপী মসজিদ বিতর্ককেও।
[আরও পড়ুন: ব্রিগেডে সিপিএমের চেনা ছক ভাঙলেন মীনাক্ষীরা]
শুধু তাই নয়, সংখ্যালঘুদের কাছে মন্দিরকে গ্রহণযোগ্য, স্বাভাবিক করে তুলতে চেষ্টার খামতি নেই। তাই রামজন্মভূমি-বাবরি জমি মামলার প্রাক্তন মামলাকারী ইকবাল আনসারিও ২২ জানুয়ারির প্রাণপ্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠানে ডাক পান। করোনাকালের মধ্যে মন্দিরের ‘ভূমিপূজন’ অনুষ্ঠানেও ডাকা হয়েছিল তাঁকে। আবার ২০২৪ এর লোকসভা ভোট মাথায় রেখে গোটা উত্তরপ্রদেশের মুসলিম মহিলাদের কাছে মোদীর বার্তা তুলে ধরার কর্মসূচি শুরু হচ্ছে ১২ জানুয়ারি থেকে। ‘শুক্রিয়া মোদি ভাইজান’ পোশাকি নামের আড়ালে মুসলিম মহিলা ভোটই এর লক্ষ্য।
এমন প্রচার অভিযানের সঙ্গে বিরোধীদের পাল্লা দেওয়া সত্যিই কঠিন কাজ। তাঁরা কী করতে পারেন? একের পর এক নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে, ধর্মের ইস্যুতে বিজেপির মোকাবিলা করা যায় না। একের পর এক গোল করে যাচ্ছে বিজেপি। অথচ বিরোধী শিবির সেই জুতোতেই পা গলাচ্ছে বারবার। উগ্র হিন্দুত্বের পাল্টা নরম হিন্দুত্ব, রামমন্দিরের পাল্টা দীঘায় জগন্নাথ মন্দির, একসঙ্গে বিজেপি-তৃণমূল কর্মীদের রামনবমীর মিছিলে হাঁটা-এটা গেরুয়া মোকাবিলার রাস্তা নয়।
বরং মূল্যবৃদ্ধি, প্রয়োজনের তুলনায় কম হাসপাতাল, হাসপাতালে উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি, হাতে হাতে কাজ দেওয়ার জন্য শিল্পস্থাপন–এইসব ইস্যুতে ধর্মীয় ভাবাবেগ, উন্মাদনা তৈরির উল্টো পথে হাঁটুক বিরোধীরা। একদিন না একদিন সাফল্য আসবেই।