ঋত্বিক আচার্য: সারা দেশে করোনা টেস্টের সংখ্যা প্রায়শই লাফিয়ে বাড়ছে বেশ খানিকটা। এমনকী অতিক্রম করে ফেলেছে দৈনিক ১০ লাখের লক্ষ্যমাত্রাও। খুব স্বাভাবিকভাবে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সংক্রমিতের সংখ্যা। যদিও বিগত কয়েক দিনে মোট টেস্টের মাত্র ৭-৮ শতাংশ মানুষকেই আক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। একবারে সংখ্যাটা নেমে এসেছে প্রায় ৩-৫ শতাংশ। তাহলে তো সবমিলিয়ে পরিসংখ্যান ইতিবাচকই। তাই না? টেস্ট বাড়ছে অথচ সংক্রমণের হার লাগাতার কমছে, এর থেকে বেশি ‘পজিটিভ’ খবর আর কী-ই বা হতে পারে! কিন্তু ঠিক এখানেই একটা বড় খটকা থেকে যাচ্ছে। রীতিমতো ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ করোনা নির্ধারণকারী পরীক্ষা RTPCR-এর সংখ্যা কী করে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে ফেলল বিভিন্ন রাজ্য? সংখ্যা বেড়ে কোথাও ৫০ হাজার তো কোথাও ছাড়িয়েছে ১ লক্ষের গণ্ডি। এটা কি RTPCR টেস্টের পরিকাঠামোগত উন্নয়ন নাকি বিকল্প ব্যবস্থার ইঙ্গিত?
আমাদের দেশে Covid-19 সংক্রমণ নির্ধারণের জন্য চলছে মূলত চাররকমের টেস্ট। RTPCR তো আছেই, পাশাপাশি রয়েছে অ্যান্টিজেন টেস্ট, ট্রুনাট এবং অ্যান্টিবডি নির্ধারণকারী টেস্ট। গত ১৪ জুন দেওয়া একটি অ্যাডভাইজারিতে ICMR পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছিল, RTPCR-এর পাশাপাশি চালানো যেতেই পারে অ্যান্টিজেন নির্ধারণকারী টেস্ট। কী এই অ্যান্টিজেন নির্ধারণকারী টেস্ট? আদপে এটি Covid-19 অ্যান্টিজেনের উপস্থিতি দ্রুত নির্ধারণকারী একটি কিট। মাত্র ৪৫০ টাকায় ১ ঘণ্টার মধ্যেই জানান দেবে নমুনাতে করোনার উপস্থিতি। সময়, খরচ এবং দেশের সুবিশাল জনসংখ্যাকে মাথায় রেখেই বিভিন্ন প্রান্তে ব্যাপক হারে শুরু হয়েছে এই পদ্ধতির ব্যবহার।
[আরও পড়ুন: সারা দেশে কি সত্যিই কমছে করোনা সংক্রমণ? নিম্নমুখী সংখ্যার নেপথ্যে অন্য কারণ নেই তো?]
ICMR-এর মুখ্য অধিকর্তা বলরাম ভার্গব ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন যে সারা দেশের অন্তত ২৫-৩০ শতাংশ করোনা টেস্টই হচ্ছে ব়্যাপিড কিটের মাধ্যমে। ব়্যাপিড টেস্টের ব্যবহারের হার যে ক্রমে বেড়েই চলেছে, তা একটু খতিয়ে দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। যেমন দিল্লিতে প্রতি ১০টা টেস্টের প্রায় ৭টাই এই মুহূর্তে ব়্যাপিড টেস্ট। মহারাষ্ট্রে প্রায় ৬০% টেস্ট বর্তমানে ব়্যাপিড টেস্ট। মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদে ৩ আগস্ট ৯৭% টেস্টই হয়েছে ব়্যাপিড কিট ব্যবহার করে। ব্যতিক্রমী নয় উত্তরপ্রদেশও। সেখানে মোট টেস্টের ৫০ শতাংশেরও বেশি হয়েছে ব়্যাপিড টেস্টই। আবার ওড়িশায় এর হার প্রায় ৭৫%।
ব়্যাপিড টেস্টের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে দ্রুত বদলাচ্ছে পরিসংখ্যাণও। ক্রমেই কমছে টেস্টের সংখ্যার অনুপাতে সংক্রমিতের হার। উল্লেখযোগ্যভাবে দিল্লিতে আক্রান্তের হার কমে ৬.৫%, উত্তরপ্রদেশে ৪.৫% এবং ওড়িশায় ৫%-এর কাছাকাছি। তবে এই আনুপাতিক সংখ্যা হ্রাসে মোটেই ইতিবাচক ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা। কারণ ICMR-এর মতে, এই ব়্যাপিড টেস্টের সাফ্যলের হার ৫০.৬-৮৪ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রেই আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে যেতে পারেন ‘সংক্রমনহীনে’র তালিকায়। যদি দৈনিক সারা দেশে মোট ৩০ শতাংশ ব়্যাপিড টেস্টের মধ্যে ৫০% টেস্টের ফল সঠিক না আসে, সেক্ষেত্রে দৈনিক টেস্টের আওতাভুক্ত দেড় লক্ষের কাছাকাছি সংখ্যার মানুষের টেস্ট রিপোর্ট নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। যা নিঃসন্দেহে উদ্বিগ্নের।
ধোঁয়াশা রয়েছে আরও কিছু ক্ষেত্রে। যেমন দৈনিক সারা দেশে মোট টেস্টের কত সংখ্যক RTPCR-এ হচ্ছে বা কত সংখ্যক ব়্যাপিড টেস্ট হচ্ছে, তা একেবারেই স্পষ্টভাবে জানা যাচ্ছে না। ফলে সব গণনাই হচ্ছে অনেকটা আন্দাজের ভিত্তিতে। যা করোনার মতো অতিমারী নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বেশ বিপদজনক। অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল স্কুলের অধ্যাপক পিটার কলিগনন সিঁদুরে মেঘ দেখছেন। তাঁর মতে, আক্রান্ত অথচ ব়্যাপিড টেস্ট অনুযায়ী সুস্থ ব্যক্তির থেকে হতে পারে ভয়াবহ গোষ্ঠী সংক্রমণ (Community Transmission)।
করোনা টেস্টের ক্ষেত্রে RTPCR-ই হল শেষ কথা। বিজ্ঞানীদের ভাষায় ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড টেস্ট’। জনগোষ্ঠীর সংক্রমণ পরিস্থিতি বোঝার জন্য ব়্যাপিড টেস্ট ব্যবহার করা হলেও ব্যক্তি পিছু টেস্টের নিরিখে সংক্রমণের হার বাড়ছে না কমছে, তা এই পদ্ধতিতে বোঝা প্রায় অসম্ভব। আর যদি দুই বা চাররকমের টেস্টের ফল থেকে বোঝার চেষ্টা করা হয়? তাহলেও জট পাকবে। কারণ প্রত্যেকের সাফ্যলের হার আলাদা। ফিলিপিন্সে এই ব়্যাপিড টেস্টের ভ্রান্ত ফল বেশ বড় আকারের সংক্রমণ ডেকে এনেছিল। মার্কিন মুলুক বা ব্রিটেন কিন্তু আগাগোড়া ভরসা রেখেছে RTPCR-এর উপরই।
[আরও পড়ুন: সরকারের দায়িত্ব নাগরিকদের জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সুরক্ষিত করা, পরিচয়পত্র বা প্রকল্প তৈরি নয়]
সংক্রমিতের সংখ্যায় আমাদের দেশ ইতিমধ্যেই ৩০ লক্ষের গণ্ডি টপকে গিয়েছে। আমেরিকা এবং ব্রাজিলের তুলনায় ভারতে দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। RTPCR, অ্যান্টিজেন ব়্যাপিড টেস্ট, ট্রুনাট, এবং অ্যান্টিবডি টেস্ট- সব মিলিয়েও প্রতি ১০ লক্ষে আমাদের টেস্ট সংখ্যা এখনও বেশ কমই। ব্রাজিলের প্রায় ৩ ভাগের একভাগ এবং রাশিয়া ও মার্কিন মুলুকের ১০ ভাগের এক ভাগ। তারই মাঝে যদি টেস্টের বিভ্রান্তিকর সমীক্ষা সামনে আসতে থাকে, তবে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করায় খুব বড় ভুল থেকে যাবে।
The post রোজ করোনা আক্রান্তের সঠিক সংখ্যা জানতে পারছেন তো? ব়্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট বাড়াচ্ছে ধন্দ appeared first on Sangbad Pratidin.