shono
Advertisement
End of Globalisation

বিশ্বায়নের বিলুপ্তির পথে দুনিয়া?

নয়ের দশকের গোড়ায় যে বিশ্বায়নের সূচনা ঘটেছিল, তার ভিত্তি ছিল দেশে দেশে শুল্কের বেড়া ভেঙে দেওয়া।
Published By: Kishore GhoshPosted: 09:24 PM Apr 08, 2025Updated: 09:24 PM Apr 08, 2025

এমনই ইঙ্গিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মারের। ট্রাম্পের ধারণা, তাঁর শুল্ক নীতি মার্কিন সংস্থাগুলিকে হৃত বাজার ফিরিয়ে দেবে। সংস্থাগুলি ফের লগ্নি করবে এবং শ্রমিক শ্রেণি কাজ ফিরে পাবে। ট্রাম্পের এই বার্তা মার্কিনিদের কাছে একেবারেই বিশ্বাসযোগ‌্য নয়। সাধারণ মার্কিনিদের বিক্ষোভ সে-কথাই প্রমাণ করছে। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী

Advertisement

বিশ্বায়নের বিপরীত রাস্তায় কি দুনিয়ার পথ চলা শুরু হল?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক নীতি এই প্রশ্ন উসকে দিয়েছে অর্থনীতিবিদ, সমাজবিদ ও রাষ্ট্রনেতাদের মধ্যে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মার ইতিমধ্যে বিশ্বায়নের পরিসমাপ্তির ইঙ্গিত দিয়েছেন। লেবার পার্টির নেতা জানিয়েছেন, ‘বিশ্বায়ন’ শ্রমিক শ্রেণির কাছে আশীর্বাদ হয়নি। দেশে দেশে তারা কাজ হারিয়েছে। দুনিয়াকে ফের বিশ্বায়ন পূর্ববর্তী জমানায় ফিরতে হবে, যেখানে প্রতিটি দেশে শুল্কের প্রাচীর ছিল। দেশীয় শিল্পের জন‌্য সুরক্ষিত বাজার ছিল।

শুল্ক নীতি ঘোষণা করার দিনটিকে ট্রাম্প আমেরিকার আরও একটি ‘স্বাধীনতা দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করেছেন। এটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ ঘোষণা। তিনি দাবি করেছেন তাঁর শুল্ক নীতি, আমেরিকার শিল্প ও বাণিজ‌্য সংস্থাগুলির পুনরুজ্জীবন ঘটাবে। বস্তুত, স্টার্মার বিশ্বায়নের যুগ শেষ হয়ে যাওয়ার যে-কথা খুব স্পষ্টভাবে বলছেন, ট্রাম্প সেই বার্তাটাই কিছুটা পরোক্ষভাবে দিয়েছেন।

নয়ের দশকের গোড়ায় যে বিশ্বায়নের সূচনা ঘটেছিল, তার ভিত্তি ছিল দেশে দেশে শুল্কের বেড়া ভেঙে দেওয়া। মুক্তবাণিজ্যের পরিবেশ তৈরির জন‌্য জন্ম নিয়েছিল ‘বিশ্ব বাণিজ‌্য সংস্থা’ তথা ‘ডব্লিউটিও’। যার সদস‌্য বিশ্বের প্রায় সব দেশ। দফায় দফায় ডব্লিউটিও-র বৈঠক করে অান্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি পরিকাঠামো বানিয়েছিল দেশগুলি। ট্রাম্পের একতরফা শুল্ক নীতি ডব্লিউটিও-র কাঠামোটিকেই অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়েছে। এখন প্রতিটি দেশ আমেরিকার মতো নিজের নিজের শুল্ক প্রাচীর তুলতে চাইলে মুক্তবাণিজ‌্য বলে কিছু থাকবে না। বিশ্বায়ন শব্দটিও সেক্ষেত্রে ইতিহাসের গর্ভে চলে যাবে।

বিশ্বায়ন ইতিহাসের গর্ভে চলে গেলে দেশে দেশে কি শ্রমিক শ্রেণি তাদের হারানো চাকরি ফিরে পাবে? রাতারাতি দেশে দেশে কি আমদানি প্রতিস্থাপনকারী শিল্প গড়ে উঠবে? ট্রাম্প মনে করছেন তাঁর শুল্ক নীতি মার্কিন সংস্থাগুলিকে হৃত বাজার ফিরিয়ে দেবে। সংস্থাগুলি ফের লগ্নি করবে এবং শ্রমিক শ্রেণি কাজ ফিরে পাবে। ট্রাম্পের এই বার্তা অবশ‌্য মার্কিনিদের এখনও বিশেষ অাশ্বস্ত করতে পারছে না। গত কয়েক দিন ধরে অামেরিকার শহরে শহরে যে-বিক্ষোভ চলছে, তা দেখেই সেটা মালুম হচ্ছে। ট্রাম্প দ্বিতীয়বার মার্কিন প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসেই সরকারি কাজে দক্ষতা বৃদ্ধি ও অপ্রয়োজনীয় খরচ কমাতে ধনকুবের ইলন মাস্কের নেতৃত্বে কমিটি গড়েছিলেন। প্রায় ২ লক্ষ কর্মীর চাকরি নট করে মাস্ক সরকারের বছরে
১ লক্ষ কোটি ডলার বাঁচিয়ে দেওয়ার দাবি করছেন। ট্রাম্প-মাস্কের সেই ছাঁটাইনীতির প্রতিবাদে মার্কিনিরা পথে। ট্রাম্পের চাকরি ফেরানোর আশ্বাস যদি সাধারণ মার্কিনিরা বিশ্বাসই করত, তাহলে শুল্ক নীতি ঘোষণার পরেও তারা এইভাবে রাস্তায় নামত না। এই বিক্ষোভ দেখে মনে হচ্ছে, ট্রাম্পের দ্বিচারিতাকেই যেন প্রশ্নের মুখে ফেলা হচ্ছে।

বিশ্বায়নের বিলুপ্তি কি ভারতে বেকারত্ব কমাবে? ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থা তাদের রিপোর্টে জানিয়েছে– মার্চ মাসে ভারতের শ্রমবাজারে কর্মীর সংখ‌্যা ৪২ লক্ষ কমে গিয়েছে। এদের মধ্যে কিছু ছাঁটাই হয়েছে, কিছু শ্রমের বাজার থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। এসব নিয়ে এখন হইচই হচ্ছে। যদি বিশ্বায়নের অবলুপ্তি ভারতেও কিছু কারখানা গড়ে ওঠার পক্ষে সহায়ক হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই শ্রমবাজারের এই চিত্রটা বদলাবে। ট্রাম্প ভারতীয় পণ্য়ের উপর ২৬ শতাংশ শুল্ক চাপানোর কথা ঘোষণা করলেও কেন্দ্র সরকার এখনও পাল্টা শুল্কের কথা ঘোষণা করেনি। কিন্তু বিশ্বায়নের বিলোপ ঘটলে ভারতকেও শুল্কের প্রাচীর তুলে রক্ষণশীল অর্থনীতির দিকে হাঁটতে হবে। কারণ রফতানি কমলে আমদানি কমানো ছাড়া উপায় নেই। নাহলে দেউলিয়া হয়ে যেতে হবে।

ট্রাম্প ভারতের উপর যে শুল্ক চাপিয়েছেন, তাতে ভারতীয় শিল্প তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বলে দাবি করছে বিভিন্ন বণিকমহল। ভারতের তুলনায় বেশি শুল্ক চেপেছে চিন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ ইত‌্যাদি দেশের পণ্যের উপর। ভারত বরং তার ফায়দা পেতে পারে বলে অনেকে আশা করছে। মার্কিনি উপভোক্তা ও শিল্পসংস্থাগুলি কিছু ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে দামি চিনা, কোরিয়ান, ভিয়েনামি বা বাংলাদেশি পণ‌্য ছেড়ে ভারতীয় পণ‌্য নিতে পারে। কিন্তু বিশ্বায়ন বিলুপ্ত হলে ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা চিন-জাপানও আমেরিকার মতো সব দেশের আমদানির উপরই চড়া শুল্ক বসাবে। তখন ভারতেরও পাল্টা শুল্ক বসানোর রাস্তায় হাঁটা ছাড়া ‘বিকল্প’ কিছু করার থাকবে না।

বিদেশি পণ‌্য আমদানি বন্ধ হলে দেশের বাজার ধরতে ভারতীয় শিল্পসংস্থাগুলি কি লগ্নির পথে এগবেই? না কি তখনও তারা দোলাচলে থাকবে? ট্রাম্পের কার্যকলাপে ‘অ‌্যাপল’-এর মতো সংস্থা উদ্বিগ্ন। পাল্টা হিসাবে ভারত যদি আইফোনের উপর চড়া শুল্ক চাপিয়ে দেয়, তাহলে কী হবে? বিশ্বায়নের বিলুপ্তি হলে ভারতে অ‌্যাপলের কারখানা টাটা বা রিলায়েন্স অধিগ্রহণ করবে, এমন পরিস্থিতি হতেই পারে। তখন আইফোনের বাজার তাদের দখলে আসবে। বিশ্বায়নের নীতির নির্যাস হল যে, পণ্যের উৎপাদনে যার বেশি দক্ষতা, সে সেই পণ‌্য উৎপাদন করবে। অন‌্যরা সেটা সস্তায় তার কাছ থেকে পেয়ে যাবে। সেই নীতি অনুযায়ী-ই গত
তিন দশকে বিশ্বে পণ্যের জোগান শৃঙ্খলা গড়ে উঠেছে। ট্রাম্প এই জোগান শৃঙ্খলাকে ভেঙে ফেলতে উদ‌্যত হয়েছেন। এটা সর্বজনবিদিত যে, বিশ্বায়ন পরবর্তী জোগান শৃঙ্খলায় চিন বিশ্বের প্রধান উৎপাদন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। ফলে যাবতীয় কর্মসংস্থান একমাত্র চিনেই।

ট্রাম্প যদি তাঁর শুল্ক নীতিকে হাতিয়ার করে বিশ্বায়ন পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরতে চান, আমেরিকাকে ফের দুনিয়ার উৎপাদন কেন্দ্র বানাতে চান, তাহলে ভারতের মতো দেশগুলি হাত গুটিয়ে বসে থাকবে কেন? কিয়ের স্টার্মারের ইঙ্গিত, ব্রিটেন চুপচাপ বসে থাকবে না। বিশ্বায়নের অবসানের জন‌্য তিনি অপেক্ষা করছেন। কারণ কাজের দাবিতে ব্রিটিশ শ্রমিকরাও এখন পথে। ভারতের শ্রমিক ও কর্মজীবী মানুষের কান্না কি অামাদের কেন্দ্রীয় সরকারের কানে পৌঁছয়? নিশ্চয়ই না। তাহলে নরেন্দ্র মোদিকেও এত দিনে দেখা যেত স্টার্মারের মতো বিশ্বায়নের অবলুপ্তির ভবিষ‌্যদ্বাণী করতে।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • ট্রাম্প ভারতের উপর যে শুল্ক চাপিয়েছেন, তাতে ভারতীয় শিল্প তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বলে দাবি করছে বিভিন্ন বণিকমহল।
  • বিদেশি পণ‌্য আমদানি বন্ধ হলে দেশের বাজার ধরতে ভারতীয় শিল্পসংস্থাগুলি কি লগ্নির পথে এগবেই?
Advertisement