shono
Advertisement

Breaking News

West Bengal SIR News

যে কোনও মূল্যে বাংলা দখলের ইনস্ট্রুমেন্ট ‌‌‘SIR’!

যে সহনাগরিকরা মারা গেলেন, তাঁদের মৃত্যুর দায় কে নেবে?
Published By: Biswadip DeyPosted: 11:53 AM Dec 02, 2025Updated: 02:58 PM Dec 02, 2025

এসআইআর’ বা ‘স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন’ প্রয়োজন হয় ভোটার তালিকাকে সম্পূর্ণভাবে নির্ভুল ও স্বচ্ছ রাখার জন্য। প্রায় ২২ বছর বাদে ভারতে ‘এসআইআর’ হচ্ছে। প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের কতখানি সদয় ও নিষ্ঠ? মনে হচ্ছে, যে-কোনও মূল্যে বাংলা দখলের ইনস্ট্রুমেন্ট যেন ‌‌‘এইআইআর’! লিখছেন আদিত্য ঘোষ

Advertisement


বিহার নির্বাচনের ফলপ্রকাশের পরেই একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সংবাদমাধ্যমে খুব প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘এবার বাংলার পালা।’ এই পালাবদলের খেলায় বারবার বাংলা দখলের ডাক দেওয়া হয়েছে। বাংলাকে জিতে নেওয়ার চেয়ে বাংলা দখলের ডাক দেওয়াতেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকরা। এই বিদ্বেষ কিন্তু আদতে বাংলার প্রতি তিক্ত মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। ‘জিতে নেওয়া’ এবং ‘দখল করে নেওয়া’ আক্ষরিক অর্থে অনেকটা কাছাকাছি হলেও দু’টি শব্দের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম ফারাক আছে। ভালবাসার খামতি আছে। এই ভালবাসা তখনই সম্ভব যখন দুহাত তুলে বাংলা এবং বাঙালিকে ভালবাসা যায়। বাংলার মন বুঝতে হলে– বাংলার সংস্কৃতি এবং শিকড়কে জানতে হয়।

কিন্তু দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সিলেবাসে ওসব নেই। কোনওক্রমে বাংলা দখল করলেই পারলেই তারা খুশি। পরীক্ষার আগের রাতে টেস্ট পেপার সল্‌ভ করে বাংলা পাশ করা যায় না। যাবেও না। শীতের শহরে পরিযায়ী পাখিরা না-এলেও ইতিমধ্যে ভোটের দামামা বেজে গিয়েছে। দিল্লি-কলকাতা, কলকাতা-গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ-কলকাতা করতে শুরু করেছেন অনেকে। শুধু তা-ই নয়, ‌‘এসআইআর’-এর মতো অ্যাটম বোমা ফেলেও দেওয়া হয়েছে হেমন্তের অরণ্যে। তাতে ক্ষতি অবশ্য হয়েছে। কিন্তু এসব করেও কি বাংলা দখল সফল হবে?
একটি সভ্য শিক্ষিত দেশে এসআইআর করা প্রয়োজন। ‘এসআইআর’ (West Bengal SIR) বা ‘স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন’ প্রয়োজন হয় ভোটার তালিকাকে সম্পূর্ণভাবে নির্ভুল ও স্বচ্ছ রাখার জন্য। সময়ের সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রায় নানা পরিবর্তন আসে। কেউ বাড়ি বদলায়, কেউ অন্য জেলায় চলে যায়, আবার কেউ মৃত্যুবরণ করে। সাধারণ রিভিশনের মাধ্যমে এই পরিবর্তনগুলো সবসময় ঠিকভাবে ধরা পড়ে না, ফলে তালিকায় ডুপ্লিকেট নাম, মৃত ব্যক্তি বা অন্যত্র থাকা ভোটারের নাম থেকে যায়। এই কারণে ভোটার তালিকা ধীরে ধীরে বাস্তবতার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে। ‘এসআইআর’ সেই অসামঞ্জস্য দূর করার একটি বৃহৎ প্রক্রিয়া, যেখানে প্রতিটি ভোটারকে শারীরিকভাবে চিহ্নিত ও যাচাই করা হয়। নতুন নাগরিকদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়, পুরনো ভুল সংশোধন হয় এবং ভুয়ো বা অনুপস্থিত নাম বাদ দেওয়া যায়। ফলে নির্বাচন প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ হয়।

প্রায় ২২ বছর বাদে ভারতে ‘এসআইআর’ হচ্ছে। এসআইআর প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। শুধু তা-ই নয়, এসআইআরের জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা এবং পরিকাঠামো। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের তুঘলকি সিদ্ধান্তে প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। অনেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে এসআইআরের (West Bengal SIR) জন্য বাংলায় মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৩৯ জনের। যে-সহনাগরিকরা মারা গেলেন, তঁাদের মৃত্যুর দায় কে নেবে? একটা কথা খুব চটজদলি রটে গিয়েছিল, লিস্টে নাম না-থাকলে নাকি বাংলাদেশ পাঠিয়ে দেওয়া হবে। কেউ শুনেছিল ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আরও অনেক অনেক গুজব সহজেই ছড়িয়ে পড়েছিল চারিদিকে। আসল খেলা তো ন্যারেটিভের। সেই ন্যারেটিভে বেশ পারদর্শী দক্ষিণপন্থী রাজনীতি। যে-যেমন পেরেছে সেইভাবে ন্যারেটিভ রটিয়ে দিয়েছে। বিভ্রান্ত হয়েছে সাধারণ জনগণ। বারবার উঠে এসেছে অনুপ্রবেশকারীর প্রসঙ্গ। বাংলা আর বাংলাদেশকে গুলিয়ে দেওয়া হয়েছে ইচ্ছাকৃত ভাবে। যাতে বাঙালিরা বিপদে পড়েন। যাতে বাংলার সংস্কৃতি কলুষিত হয়।

স্বাধীনতার পর প্রথম এসআইআর হয়েছিল ১৯৫০-এর সময়কালে। এরপর ১৯৫৭, ১৯৬১, ১৯৬৫ ও ১৯৬৬ সালে একাধিকবার এসআইআর করা হয়। দীর্ঘ বিরতির পর আবার এসআইআর হয় ১৯৮৩-’৮৪, ১৯৮৭-’৮৯ এবং ১৯৯২-’৯৫ সালের মধ্যে। সর্বশেষ বড়সড় দেশব্যাপী এসআইআর হয়েছিল ২০০২ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে। তারপর প্রায় দুই দশকের ব্যবধানে আবার ২০২৫ সালে দেশজুড়ে নতুন এসআইআর শুরু হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসআইআর দ্রুততার সঙ্গে হচ্ছে। বিশেষত বাংলায় এসআইআর নিয়ে বিভিন্ন প্রান্তে নানা ভ্রান্ত ধারণা ছড়িয়ে আছে।

নির্বাচন কমিশন এই ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে কী করেছে? স্কুল শিক্ষকরা সারাদিন বাড়ি বাড়ি ঘুরে ফর্ম সংগ্রহ করে রাতে সেই ফর্ম ফিলাপ করছেন। কেন ডেটা এন্ট্রি অপারেটর দেওয়া হল না? ২০২৫ সালের এসআইআর প্রক্রিয়ায় মূলত পশ্চিমবঙ্গ-সহ কয়েকটি রাজ্যে জোর দেওয়া হয়েছে, কিন্তু অন্যান্য সীমান্তবর্তী রাজ্য, যাদের গঠন, জনসংখ্যার ঘনত্ব বা আবাসিক পরিস্থিতি হয়তো আরও জটিল, সেখানে একইভাবে এসআইআর কেন চালানো হয়নি? সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর ভোটার তালিকা আপডেটের প্রয়োজনও কম নয়, কিন্তু সেখানে প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। কিন্তু কেন? অনেক বিশেষজ্ঞ এই এসআইআরকে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক ভিত্তিতে অসমতা রূপে দেখছেন। বেশ কিছু মাস আগে বাংলার বাইরে বাঙালিদের নির্যাতনের ইস্যুতে গর্জে উঠেছিল রাজ্য সরকার। পথে নেমে আন্দোলনও হয়েছিল। সেই সময়ই মোটামুটি স্পষ্ট ছিল, আগামী ভোটের ইস্যু হতে চলেছে বাংলা এবং বাঙালি। সেই ইস্যুকেই থমকে দেওয়ার জন্যই কি এত দ্রুত এসআইআরের প্রয়োজন হয়ে পড়ল? সেই ইস্যু থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্যই কি বাংলা এখন পাখির চোখ?

কিছু দিন আগে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দাপ্রধান বাংলা ঘুরে গিয়েছেন। শোনা গিয়েছে তিনি নাকি বাংলার এসআইআর নিয়ে নজর রাখছেন। শুধু তা-ই নয়, বাংলার যেসব অঞ্চলে সংখ্যালঘুদের বসবাস বেশি, সেই অঞ্চলের এসআইআর নিয়ে সতর্ক করেছেন নির্বাচন কমিশনকে। প্রসঙ্গত, এসআইআর নিয়ে যতটা ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি অপপ্রচার হচ্ছে। এনআরসি, সিএএ-র সঙ্গে এসআইআর গুলিয়ে খাওয়ানো হচ্ছে বাংলায়! কারণ বাংলা দখল করতে হবে! সেই দখল করার লক্ষ্যে সহনাগরিকদের প্রাণ গেলেও, কারও কাছে কোনও সদুত্তর নেই।

জীবনের চেয়েও বড় কি বাংলা দখল করা? উত্তর আছে দক্ষিণপন্থী রাজনীতিদের কাছে? বাংলার ভোট ও জনসংখ্যা নিয়ে যে ডেমোগ্রাফিক ভয় তৈরি করা হচ্ছে, তা এখন স্পষ্টভাবে একটি রাজনৈতিক অস্ত্র রূপে ব্যবহৃত হচ্ছে। সংখ্যালঘু বা প্রবাসী সম্প্রদায়ের ওপর ভিত্তি করে ভীতি রোপণ করা হচ্ছে, যাতে সাধারণ মানুষ ভাবতে বাধ্য হয়, এলাকায় অন্য কেউ বেশি হয়ে গেলে তঁাদের অধিকার বা সুযোগ কমে যাবে। এই মনস্তাত্ত্বিক চাপ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো হচ্ছে, যাতে ভোটাররা বিভ্রান্ত হন, আতঙ্কিত হন এবং সেই আতঙ্কের প্রভাবের ওপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক সমর্থন সরবরাহ করেন। এনআরসি, এসআইআর এবং অনুপ্রবেশকারীর ভীতি একসঙ্গে মিশিয়ে প্রচার করা হচ্ছে, যেখানে বাংলার অভিজ্ঞতা ও স্থানীয় বাস্তবতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। এর ফলে রাজনৈতিক ‌‘ক্ষমতা অর্জন’ বা ‘দখল করা’-ই মূল লক্ষ্য হয়ে উঠেছে।
ডেমোগ্রাফিক ভয় কেবল সংখ্যা বা জনসংখ্যার বিষয় নয়। এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক অস্ত্র, যা রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে বাংলার জনগণকে লক্ষ্য করে ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলার স্নিগ্ধ, শীতল সংস্কৃতি কি ঘেঁটে যাবে কোনও রাজনৈতিক চক্রান্তে? আমরা কি মুখ বুঝে সহ্য করব এই মৃত্যুমিছিল?
(মতামত নিজস্ব)

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
Advertisement