আগত বিয়ের মরশুম ধরলে, জিএসটি কমার পরে, কেনাকাটার পরিমাণ ৭ লক্ষ কোটি টাকা ছাপিয়ে যাবে। ব্যবসায়ীদের একটি অংশ তৃপ্ত। কিন্তু বাজার যখন চাঙ্গা, তখন রাজ্যগুলির আর্থিক স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে পড়ছে। অথচ অবলীলায় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, রাজে্যর সঙ্গে তঁাদের ‘মাই-বাপে’র সম্পর্ক নয়! লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
এবার দীপাবলির অাগে বাজার-হাটে মাত্রাতিরিক্ত ভিড় লোকের নজর কেড়েছে। ‘জিএসটি’ কমার প্রভাব সাধারণ মানুষের কেনাকাটায় প্রবলভাবে পড়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে চর্চা শুরু হয়েছে। ৮ সেপ্টেম্বর জিএসটি পর্যদের বৈঠকে ১২ ও ১৮ শতাংশের করের হার তুলে দিয়ে সব পণ্যকে ৫ ও ২৮ শতাংশের করের হারে নিয়ে অাসার সিদ্ধান্ত হয়। বেশিরভাগ পণে্যর জিএসটি-ই ১২ ও ১৮ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশের হারে চলে অাসে। ২২ সেপ্টেম্বর নবরাত্রির শুরুর দিন থেকে সারা দেশে জিএসটির এই নতুন হার চালু হলেও– প্রভাব পড়তে-পড়তে প্রায় একমাস লাগল। দীপাবলির অাগে এসে বোঝা গেল জিএসটি কমার প্রভাব বাজারে ‘বাম্পার’।
সদ্য সাংবাদিক বৈঠক করে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন, বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়াল এবং ইলেকট্রনিক্স ও তথ্যপ্রযুক্তি অশ্বিনী বৈষ্ণব জানিয়েছেন– জিএসটি কমার প্রভাব পুরোপুরি উপলব্ধি করতে জানুয়ারি মাস হবে। এটা ঘটনা যে, উৎসবের মরশুম শেষ হতে হতে সেই নতুন বছর। পুজোপাট্টার দিন চলে যাওয়ার পর বিয়ের মরশুম শুরু হয়ে যাবে। তারপর বড়দিন ও নববর্যের উৎসব। বণিকদের কয়েকটি সংগঠন ইতিমধে্য দাবি করতে শুরু করেছে, দুর্গাপুজো ও দীপাবলি মিলিয়ে দেশে প্রায় ৫ লক্ষ কোটি টাকার কেনাবেচা হয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা জানিয়েছেন, বিয়ের মরশুম ধরলে জিএসটি কমার পর কেনাকাটার পরিমাণ ৭ লক্ষ কোটি টাকা ছাপিয়ে যাবে। এতে হয়তো অতিরঞ্জন কিছু নেই। অষ্টমীর দিন নাকি দেশে মারুতির গাড়ি বিক্রি হয়েছে ৩০ হাজারের বেশি। যা মারুতির চার দশকের ইতিহাসে একটা রেকর্ড। গাড়ি-বিক্রেতাদের সংগঠন ‘ফাডা’-র দাবি গত বছরের তুলনায় তারা ৩৫ শতাংশ বেশি গাড়ি এবার বিক্রি করবে। পোশাক-বিক্রেতারা জানিয়েছে, তাদের বিক্রি এবার ২০ শতাংশ বাড়বে। বৈষ্ণব দাবি করেছেন, টিভি ও ফ্রিজ-সহ ইলেকট্রনিক্স পণ্য সামগ্রীর বিক্রি ২০-২৫ শতাংশ বাড়বে। কোনও দাবিই হয়তো অমূলক নয়। ভূতচতুর্দশীতে রাজে্য বহু টিভি-ফ্রিজের দোকান দেখা গেল মধ্যরাতের পরেও কেনাবেচা করছে। এখন দোকান থেকে যত লোক টিভি-ফ্রিজ-ওয়াশিং মেশিন কেনে, তার চেয়ে বেশি কেনে অনলাইনে। অ্যামাজন-ফ্লিপকার্টে মহা সেলের বাজারে এবার ক্রেতার সংখ্যা গতবারের কয়েক গুণ।
উৎসবের মরশুমে এই হইচই ফেলা ব্যবসা-বাণিজ্য সত্ত্বেও জিএসটির ক্ষতি নিয়ে বিতর্ক কিন্তু থামছে না। অর্থনীতিবিদরা যখন বাজারে একসঙ্গে শেয়ার ও সোনার লাগাতার দাম বৃদ্ধির মতো বেনজির ঘটনার রহস্য সমাধানে ব্যস্ত– তখন কিন্তু রাজে্যর অর্থমন্ত্রীদের উদ্বেগ কমছে না জিএসটি থেকে অায় কমার অাশঙ্কায়। জিএসটি পর্যদের বৈঠকে পেশ করা প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, জিএসটি হার কমায় বছরের বাকি সময়ের জন্য রাজস্ব ক্ষতি হবে মোট ৯৩ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু জিএসটি হার কমায় বাজারে যে-হারে বিক্রিবাটা বাড়বে তাতে অতিরিক্ত ৪৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব অাদায় বাড়বে। নিট ক্ষতি ৪৮ হাজার কোটি টাকা। বাংলার মতো বড়-বড় রাজ্যে ১০ হাজার কোটি টাকার মতো রাজস্ব ক্ষতির আশঙ্কা করছে। রাজ্যগুলির অার্থিক ক্ষতির এই ধাক্কা কিন্তু ঘুরে এসে দেশের অর্থনীতির উপরই পড়বে।
এটা সতি্যই একটি বড় ধঁাধা যে, যখন ব্যবসা-বাণিজে্য এইরকম ধুম লেগেছে, বাজার ক্রমশ চাঙ্গা হচ্ছে, তখন রাজ্যগুলির অার্থিক স্বাস্থ্য ক্রমশ খারাপ হয়ে পড়ছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা জানিয়েছেন, গত অর্থ বছরে দেশের জিডিপি ছিল ৩৩৫ লক্ষ কোটি টাকা। সারা বছরে কেনাবেচা হয়েছিল, ২০২ লক্ষ কোটি টাকার।
জিএসটি কমার পর কেনাবেচা যদি ১০ শতাংশও বাড়ে তাহলে অতিরিক্ত ২০ লক্ষ কোটি টাকা কেনাবেচায় খরচ হবে। এই পরিমাণ ব্যবসা বৃদ্ধি সত্ত্বেও কেন্দ্র কিন্তু অাশার অালো দেখাতে পারছে না উদ্বিগ্ন রাজ্য সরকারগুলিকে। সাংবাদিক বৈঠকে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কেন্দ্র রাজ্যগুলিকে জিএসটির ক্ষতিপুরণ দিতে পারবে না। নির্মলার মন্তব্য, ‘রাজে্যর সঙ্গে অামাদের মাই-বাপের সম্পর্ক নয়।’ তঁার এই মন্তবে্য বিতর্ক তুঙ্গে।
‘মাই-বাপ’ বলতে নির্মলা বুঝিয়েছেন, রাজে্যর প্রতি কেন্দ্র দায়িত্বশীল অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতে পারবে না। জিএসটির ক্ষতির দায় রাজ্যকেই নিতে হবে। রাজে্যর প্রতি কেন্দ্র দায়িত্বশীল অভিভাবকের ভূমিকা নিতে না-চাইলেও, রাজ্য সরকারগুলিকে কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি দায়িত্বশীল অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতে হয়। অামাদের দেশের সংবিধান অনুযায়ী, সামাজিক প্রকল্প ও রাষ্ট্রের জনকল্যাণমূলক কাজে যত ব্যয় হয়, তার ৫৬ শতাংশের অার্থিক দায় রাজ্যগুলির।
মনে রাখতে হবে, জিএসটির হার কমায় বাজারে যে ব্যবসা-বাণিজে্যর ধুম তার বাইরে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতা। যঁার চাকরি নেই কিংবা যঁার বেতন বা অায় কয়েক বছর ধরে বাড়ে না, তঁার তো এই জিএসটি কমায় খুব একটা কিছু এসে-যায় না। চূড়ান্ত বেকারত্ব ও অসহনীয় অার্থিক বৈষমে্যর এই যুগে অসহায়দের পাশে দঁাড়াতে হয় রাজ্য সরকারগুলিকেই। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী ইত্যাদি সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলি নিয়ে গরিব মানুষের পাশে, বাজার ব্যবস্থার বাইরে বাস করা মানুষদের পাশে দঁাড়াতে হয় মমতা বন্দে্যাপাধ্যায়দেরই। অথচ অবলীলায় নির্মলা বলতে পারছেন যে, রাজে্যর সঙ্গে তঁাদের ‘মাই-বাপে’র সম্পর্ক নয়। এটাই জিএসটি চালু করার সবচেয়ে বড় পরিহাস!
সম্প্রতি, দেশের ‘কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল’ প্রকাশ করেছেন এক দশকে রাজ্যগুলির অার্থিক স্বাস্থ্য নিয়ে সুসংহত রিপোর্ট, ‘স্টেট ফিনান্সেস ২০২২-২৩: অা ডিকেডাল অ্যানালিসিস’। এই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, নরেন্দ্র মোদির সরকারের অামলেই রাজ্যগুলির অার্থিক স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছেে। ২০২২-’২৩ সালে দেশের সব রাজ্য মিলিয়ে বাজেটে খরচ করেছে ৪২.৪৩ লক্ষ কোটি টাকা। দেশের জিডিপির ১৬.৩৫ শতাংশ। ২০১৬-’১৭ সালে এই খরচ ছিল জিডিপির ১৭.৫৪ শতাংশ। ২০২৩-’২৪ বা ২০২৪-’২৫ সালের এই তথ্য এখনও ‘সিএজি’ প্রকাশ করেনি। সেই তথ্য এলে দেখা যাবে, জিডিপির নিরিখে রাজ্যগুলির ব্যয় করার পরিমাণ অারও কমে গিয়েছে। রাজ্যগুলির আয় কমছে বলেই ব্যয় কমছে। রাজ্যগুলির অায়ের এক-চতুর্থাংশ অাসে কেন্দ্রীয় করের ভাগ থেকে। ২০১৮-’১৯ সালে সেই করের ভাগ ছিল জিডিপির ৪.১ শতাংশ। ২০২২-’২৩ সালে সেটা কমে দঁাড়িয়েছে ৩.৬৫ শতাংশ। রাজ্যগুলিকে যে-অনুদান কেন্দ্র দেয় তা ২০২০-’২১ সালে ছিল ২.২৮ শতাংশ। ২০২২-’২৩ সালে সেটা কমে হয়েছে ১.৮ শতাংশ। রাজে্যর অায়ের অর্ধেক অাসে জিএসটি থেকে। এটা ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটার কথা। তা এবার ঘটবে না। জিএসটি অাদায় কমলে রাজ্যগুলির খরচ করার ক্ষমতা অারও কমবে।
চুপিসারে যে রাজ্যগুলির অার্থিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র খারাপ করে দিচ্ছে তা সিএজি-র এই রিপোর্টেই স্পষ্ট। এর সঙ্গে রয়েছে রাজনৈতিক কারণে অার্থিক বঞ্চনা। যার প্রধান শিকার পশ্চিমবঙ্গ। রাজে্য ১০০ দিনের কাজের টাকা, অাবাস প্রকল্পের টাকা বন্ধ রেখেছে কেন্দ্র। প্রচুর টাকা বকেয়া। এই পরিস্থিতিতে বাজারহাটে ভিড়ে দেখেও তাই অর্থনীতির মঙ্গল হচ্ছে বলে উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করার কিছু নেই। জানুয়ারি মাস এলে বোঝা যাবে জিএসটি থেকে অায় কোথায় গিয়ে দঁাড়াল। রাজ্য সরকারগুলির অার্থিক স্বাস্থ্য যদি কিছু ভাল হয়, তবেই গোটা সমাজের উপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
