shono
Advertisement

নগদের বিকল্প পন্থা কি ‘ডিজিটাল কারেন্সি’?

‘ডিজিটাল কারেন্সি’ ব্যবহার করে পাড়ার দোকানে কেনাকাটা করা যাবে তো?
Posted: 07:36 PM Feb 18, 2022Updated: 07:36 PM Feb 18, 2022

‘ডিজিটাল কারেন্সি’ ব্যবহার করে পাড়ার দোকানে বিস্কুটের প্যাকেট কিনতে পারব তো? বা ছেলের স্কুলের ফি জমা দেওয়া যাবে তো? ব্যবসা করে ভেন্ডরকে যদি পেমেন্ট করতে হয়, তাহলে তিনি নেবেন তো? মানুষ এই উত্তরগুলো চাইবে অচিরেই। সরকার যত শীঘ্র তা দিতে পারবে, ততই মঙ্গল। লিখছেন নীলাঞ্জন দে

Advertisement

 

ধিকিধিকি একটা আঁচ ছিলই, তবে এখনকার সর্বত্র আলোচিত বিষয়টি উসকে দিয়েছিল আমেরিকার ব্যাংক নিয়ন্ত্রক ‘ফেডেরেল রিজার্ভ’। একটি ‘ফেড’ প্রকাশনী নির্দিষ্টভাবে জানতে চেয়েছিল মার্কিন মুলুকের অভ্যন্তরীণ পেমেন্ট ব্যবস্থাকে ঠিক কীভাবে ‘CBDC’ বা ‘সেন্ট্রাল ব্যাংক ডিজিটাল কারেন্সি’ জোরদার করতে পারবে।

সাধারণ মানুষের মতামত আমন্ত্রণ করেছিল সেই দেশের সেন্ট্রাল ব্যাংক। প্রায় ২০টি আলাদা আলাদা বিষয়ের উপর পাবলিক ওপিনিয়নের নির্যাসটুকু এখনও জনসমক্ষে আসেনি। একটা প্রামাণ্য ধারণার গঠনের জন্য অপেক্ষা করছে যুক্তরাষ্ট্র। আমাদের দেশে বহুমাত্রিক চর্চা জারি থাকলেও, রিজার্ভ ব্যাংক এখনও তেমন কোনও পদক্ষেপ করেনি। সাম্প্রতিকতম বাজেটে অবশ্য অর্থমন্ত্রী হালকাভাবে ‘ডিজিটাল কারেন্সি’ নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন, কিন্তু ধরেই নেওয়া যায় তার রূপরেখা তৈরি হতে এখনও দেরি আছে। তবে ‘ই-রুপি’- এই নামটি আবছাভাবে চর্চিত এই মুহূর্তে। এখনই আসুক, বা কিছুদিন পরে, পেমেন্ট ব্যবস্থার উপর চূড়ান্তভাবে নির্ভরশীল সাধারণ ভারতবাসীর মনে একাধিক প্রশ্নের উদয় ইতিমধ্যেই হয়েছে। তা নিয়েই এই লেখার অবতারণা।

[আরও পড়ুন: উত্তরপ্রদেশ ভোটে বিজেপি জিতলে কেমন হবে দলের অভ্যন্তরীণ সমীকরণ?]

আগে কয়েকটি জানা কথা সংক্ষেপে বলে নিই। গ্রাহকই বলুন বা ব্যবসাদার, ‘ডিজিটাল মানি’-র ব্যবহার নতুন কিছু নয়, কারণ ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ট্রান্সফার বা ট্র্যানজাকশন হয়েই থাকে। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে তা যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়, অনলাইন মোডে পেমেন্ট গৃহীত হওয়ায় বাধা নেই। ইদানীং, পেমেন্ট অ্যাপ এসে ব্যাপারটা সহজতর করে দিয়েছে। যে রূপে টাকাপয়সার ট্র‌্যানজাকশন হয়, তা আসলে ব্যাংকের জন্য ‘লায়াবিলিটি’-র শামিল, কারণ সেসবের যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে হয়। একইভাবে বলা চলে যে, ‘CBDC’ দেশের সেন্ট্রাল ব্যাংকের ক্ষেত্রে লায়াবিলিটি স্বরূপই হবে। তাতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়- অসুবিধা তখনই হবে যখন ‘সেফটি’ বা নিশ্চয়তার প্রশ্নটি উঠবে। মনে রাখতে হবে, পেমেন্ট ব্যবস্থার উন্নতি আনা সরকারের তথা রিজার্ভ ব্যাংকের দায়িত্ব। এই ব্যবস্থা দ্রুত যাতে হয় তার দায়ও নিয়ন্ত্রকের। ফিনানশিয়াল স্টেবিলিটি যাতে বজায় থাকে, সেটিও প্রধান উদ্দেশ্যগুলোর অন্যতম।

এরই সঙ্গে খুব ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি অমোঘ প্রশ্ন, এখনকার প্রাইভেসি-তাড়িত বিশ্বে যার উত্তর পাওয়া অত্যন্ত জরুরি বলে আমি মনে করি। সাধারণ নাগরিকের ব্যক্তিগত পরিসরের নিজস্বতা যেন লঙ্ঘিত না হয়, তা নির্ণীত করতে হবে। এটি এ-যুগের জীবনযাত্রার অন্যতম মূল শর্ত হিসাবে ধরা হয়।হয়তো এই লেখা কিছুটা একপেশে হয়ে যাচ্ছে, তা সত্ত্বেও ‘রিস্ক রিটার্ন’ নামক বাইনারিটির প্রথমাংশ নিয়ে আগে আলোচনা করি।

দেখুন, ‘প্রাইভেসি’ বা ‘ডেটা প্রোটেকশন’ ছাড়াও, দেশের ‘মনেটারি পলিসি’-র উপর সম্ভাব্য চাপ নিয়ে নানা স্তরে চিন্তাভাবনা চলছে বলে জানা গিয়েছে। আমরা জানি, ব্যাঙ্কগুলো সাধারণভাবে জনপরিসর থেকে ডিপোজিট তোলে এবং গ্রাহকদের লোন প্রদান করে। ডিজিটাল কারেন্সি এর সুষ্ঠু ‘বিকল্প’ হয়ে উঠতে পারে কি? বিকল্প হওয়ার ফলে যদি মোট ডিপোজিটের পরিমাণ কমে, তাহলে ব্যাংকের জন্য ‘ফান্ডিং এক্সপেন্সেস’ (funding expenses) বেড়ে যেতে পারে। ফলে দু’টি জিনিস হতে পারে। এক, ‘ক্রেডিট অ্যাভেলেবিলিটি’ (credit availability) নেমে আসতে পারে। দুই, গ্রাহকদের জন্য ‘ক্রেডিট কস্ট’ (credit cost) বাড়তে পারে।

এবার আমার শেষ বক্তব্যটি আরও একটু এগিয়ে নিয়ে যাই। মনে করা যাক, এদেশের নবাগত ডিজিটাল কারেন্সি (অদূর ভবিষ্যতে) আদতে ‘ইন্টারেস্ট বেয়ারিং’ (interest bearing) এবং সেই জন্য কয়েকটি লো-রিস্ক অ্যাসেট থেকে টাকা বেরিয়ে গিয়ে নতুন কারেন্সিতে বিনিয়োগ হয়ে যাচ্ছে। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, মশাই, এই লো-রিস্ক অ্যাসেট কী? উত্তর: মানি মার্কেট সিকিউরিটিজ, ট্রেজারি বিলস বা অনুরূপ স্বল্পমেয়াদি ঋণপত্র। প্রথাগতভাবে, বলে রাখা ভাল, প্রভূত পরিমাণে অর্থ এই সমস্ত ইনস্ট্রুমেন্টে লগ্নি করা হয়ে থাকে। এই বাজার, বলা বাহুল্য, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কুক্ষিগত। তবে তা এতটাই বড় এবং জটিল যে অন্য গোত্রের অ্যাসেটে টাকা সরে গেলে অর্থনীতিতে সামগ্রিক ছাপ পড়তে বাধ্য।

তাহলে কি ‘ইন্টারেস্ট বেয়ারিং’ ডিজিটাল কারেন্সি থাকা অনুচিত? এই প্রশ্নের উত্তর এককথায় দেওয়া কার্যত অসম্ভব! তবে অল্প কথায় বলা চলে যে, তেমন হলে (বিকল্প হিসাবে) ডিজিটাল কারেন্সি সেভাবে গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে। ডিজিটাল কারেন্সির ব্যবহারে আমআদমি (সাধারণ হাউসহোল্ডার) কীভাবে উপকৃত হবেন, সে প্রশ্ন এখানে আদৌ করছি না।

তবে এই প্রশ্ন তো উঠবেই, ঠেকিয়ে রাখা যাবে না, তাও বলে রাখছি। দেশবাসী কি ‘ডিজিটাল কারেন্সি’ দিয়ে ট্র‌্যানজাকশন করতে পারবে, প্রাত্যহিক জীবনে তার ব্যবহারে কতটা সুবিধা ভোগ করতে পারবে, এবং দিনের শেষে হিসাবনিকাশ করে বুঝতে পারবে- হাতে থাকা অর্থ বাড়ল না কমল? এই সমস্ত বিষয়ের উপর কে আলোকপাত করবে, তা এখনই জানা যাচ্ছে না। ভারতে যতই ‘ইউপিআই’ আসুক এবং অনলাইনে পণ্য ক্রয়বিক্রয় হোক, ক্যাশ এখনও প্রাধান্য পেয়ে থাকে। বস্তুত, ক্যাশই একমাত্র সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক দ্বারা ইসু্য করা কারেন্সি- জনসাধারণের ভরসাস্থল, আবেগের উৎসবিশেষও বটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত অর্থনীতিতেও ক্যাশের অবদান কিছুটা এখনও রয়েছে।

২০২০ সালে করা একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, প্রায় ১৯ শতাংশ ট্রানজাকশন- মোট ভ্যালুর ৬ শতাংশ ক্যাশ মারফত। সেদেশের সেন্ট্রাল ব্যাংক ক্যাশের কৌলীন্য রক্ষা সম্বন্ধে নিশ্চয়তা দিয়েছে। অবশ্য এ-ও ঠিক যে, ডিজিটাল পেমেন্ট ক্রমাগতই ক্যাশের ব্যবহার কমিয়ে আনছে আমাদের দেশে; তা রিজার্ভ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্যেই বোঝা যায়। অন্যত্রও পরিস্থিতি এমনই রূপ নিচ্ছে। যেমন সুইডেন, যেখানে ক্যাশ পেমেন্ট (যা এক দশক আগে ৩৩ শতাংশে ছিল) দশ শতাংশের কমে নেমে এসেছে। চিনে প্রায় ৫০ শতাংশ ‘পয়েন্ট-অফ-সেল’ (Point of sale) পেমেন্ট করা হচ্ছে মোবাইল অ্যাপ বা ওয়ালেট দিয়ে। আমার কথা হচ্ছে, এ সমস্ত উদাহরণই একসূত্রে বাঁধা। সমগ্র পৃথিবীতেই বর্তমানে এটা এক বিরাট ট্রেন্ড, আগামী দিনে আরও জোরদার হয়ে উঠবে, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সেন্ট্রাল ব্যাংকেয়ের নতুন ডিজিটাইজড ব্যবস্থা (যেখানে কোনও ক্রেডিট রিস্ক নেই, এবং লিকুইডিটি নিয়েও কেউ সন্দিহান হবে না) যে বেশ গ্রহণযোগ্য হবে, সে ব্যাপারে অনেকেই নিশ্চিত।

এদেশে ‘ডিজিটাল পেমেন্টস’ সংক্রান্ত চিত্রটি এই সন্ধিক্ষণে কেমন? সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাংক গঠিত ‘ডিজিটাল পেমেন্টস ইনডেক্স’ দিয়ে পরিস্থিতি অনেকটাই বোঝানো সম্ভব। পাঁচটি মাপকাঠি ব্যবহার করে, প্রতিটিকে নির্দিষ্ট ‘ওয়েটেজ’ (weightage) দিয়ে এই সূচক তৈরি হয়েছে। সর্বোচ্চ স্কোর পেয়েছে ‘পেমেন্ট পারফর্ম্যান্স’। মার্চ, ২০১৮-কে ধরা হয়েছে ‘বেস পিরিয়ড’ হিসাবে। অগ্রগতির হিসাব নিচের টেবিল দেখলে পরিষ্কার হবে।

এছাড়াও রিজার্ভ ব্যাংক জানিয়েছে, সেপ্টেম্বর মাসে সূচক বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৩০৪.০৬ স্তরে। এই গ্রোথ, নিয়ন্ত্রকের ভাষায়, ‘অ্যাপ্রেশিয়েবল’, অর্থাৎ প্রশংসনীয়! অনেকেই সহমত প্রকাশ করবেন, মনে হয়। সূচক যাই হোক না কেন, বা অর্থমন্ত্রী বাজেটে যাই বলুন না কেন, ডিজিটাল কারেন্সি কীভাবে ভারতবাসীর উপকারে আসবে? দূরের দেশ নাইজিরিয়ার কথা উত্থাপন করা যাক, কারণ সেদেশে ‘ই-নায়রা’ ইতিমধ্যে চালু হয়েছে। দরকারি কয়েকটি তথ্য গুছিয়ে দিই এ-প্রসঙ্গে।
১. দেশজোড়া ব্যবহার, রিটেল ট্র্যানজাকশনে বিশেষ করে।
২. নাইজিরিয়ার সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে।
৩. জাল (কাউন্টারফিট) করা দুরূহ, তাই নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে ব্যবহারকারী।
৪. ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে ই-নায়রা ওয়ালেটে সরিয়ে রাখার পদ্ধতি বেশ সহজ।
৫. ফোনে ‘QR Code’ ডাউনলোড দিয়ে শুরু করতে হয়।

দূর-দূরান্তে কী হয়েছে, তা বলা কেবলমাত্র উদ্দেশ্য নয়। ভারতে আমরা এমনই পন্থা চালু করতে চলেছি, তাই হাতের কাছে যদি বিদেশের দৃষ্টান্ত থাকে, ক্ষতি নেই। শেষ পর্যন্ত ‘ই-রুপি’ (আগেই বলেছি, এটি এখনও নাম হিসাবে বৈধতা পায়নি) ব্যবহার করে পাড়ার দোকানে বিস্কুটের প্যাকেট কিনতে পারব তো? বা ছেলের স্কুলের ফি জমা দেওয়া যাবে তো? ব্যবসা করে ভেন্ডরকে যদি পেমেন্ট করতে হয়, তাহলে তিনি নেবেন তো? মানুষ এই উত্তরগুলো চাইবে অচিরেই। সরকার যত শীঘ্র তা দিতে পারবে, ততই মঙ্গল। এখন যারা আগ্রহভরে তাকিয়ে আছে, তারাও পরম নিশ্চিন্তে পরের ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করতে পারবে।

সূত্র:
১. রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া প্রকাশিত তথ্যাবলি
২. Findings from the diary of consumer payment choice, 2021- ফেডেরেল রিজার্ভের রিপোর্টে উদ্ধৃত
৩. নাইজিরিয়া সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক প্রকাশিত ই-নায়রা সংক্রান্ত তথ্য

[আরও পড়ুন: সুভাষচন্দ্র বসু কি নাৎসিদের সমর্থক ছিলেন?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement