নির্মল ধর: ছবির প্রায় শুরুতেই একটি চরিত্র বলে ওঠে,”জীবনটা তরুণ মজুমদার বই নয়….”। কথাটা অস্বীকার করছি না। তরুণবাবুর ছবিতে সুস্থ জীবনের যে বার্তা থাকে, সেটা হয়তো বাস্তবে সব সময় সেই ভাবে ঘটে না, কিন্তু ঘটলে জীবনটা অন্যরকম হত। একজন জীবনমুখী সংবেদনশীল শিল্পীর সেটাই ছবিতে দেখানো অন্যতম সৃজনশর্ত। মৈনাক ভৌমিক তাঁর নতুন ছবি “একান্নবর্তী”তে (Ekannoborti) সেটা করারই চেষ্টা করলেন। মধ্যবিত্ত বাঙালির হৃদয়ে মূল্যবোধ, প্রেম,ভালোবাসা,সহানুভূতি, শ্রদ্ধা নিয়ে একটি পরিবার কীভাবে বেঁচে থাকে, সেটাই মৈনাক দেখালেন! এবং সময়ের দাবি মেনেই তিনি মালিনী (অপরাজিতা আঢ্য) চরিত্রে যে দৃঢ়তা দেখিয়েছেন কিংবা আধুনিক মনের দুই মেয়ে যেভাবে মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছে, স্বামীর দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দেখিয়েছে, মৈনাক তার মধ্যে দিয়ে সুস্থ জীবনে ফেরার বা থিতু থাকার বার্তাই দিয়েছেন!
মৈনাক আগের ছবি “চিনি”তে কমেডির মোড়ক দিয়েছিলেন, এবার সেটা না করে অনেকটাই স্বাভাবিক ও সহজ-সরল পথে গল্প বলেছেন। প্রথম ছবি “আমরা” এবং পরবর্তী দু’তিনটি ছবিতে সিনেমার কারিগরি দেখিয়েছিলেন, সেগুলো থেকে বেরিয়ে এসে এখন মৈনাকের সিনেমার ভাষা অনেক সহজ ও স্বাভাবিক। এই “একান্নবর্তী” র মধ্যে ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘উৎসব’ ছবির অনুপ্রেরণা যে একেবারেই নেই,তা বলা যাবে না। যে কারণে তিনি ঋতুর প্রতি শ্রদ্ধা ও জানিয়েছেন ছবির শুরুতেই।
[আরও পড়ুন: Tokhon Kuasa Chilo Review: রাজনীতির কঙ্কালসার চেহারা তুলে ধরে ‘তখন কুয়াশা ছিল’ ]
কারণ গল্পের পটভূমি প্রায় একই। এক বনেদি বাঙালি দুর্গা পুজোর সময় বাইরে থাকা পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা মিলিত হচ্ছে। সেই মুহূর্তে বাড়ির বয়স্কা মালকিন (অলোকনন্দা রায়) একাই থাকেন। বাড়িটি ব্যাংককে বন্ধক দেওয়া, কিন্তু গত দু’বছর ধরে ইএমআই দেওয়া হচ্ছে না,কারণ বাড়ি ছেড়ে থাকা মেয়ে বা ছেলে কারও তেমন কোনও গ্যারাজ নেই! ঠিক এমন সংকটময় মুহূর্তে নাটকীয়ভাবে এক সিনেমা তৈরির টিমের আগমন। ওই বাড়িটি নিয়ে পুজোর শুটিং করতে চায় তারা। ইএমআই দেওয়ার অর্থ আসবে এটা ভেবেই মালকিন রাজি হয়ে যান। এ পর্যন্ত চিত্রনাট্য ঠিকঠাক। এরপর যখন বাড়ির মেয়ে মালিনী ( অপরাজিতা) তার দুই মেয়ে শীলা (সৌরসেনী) ও পিংকি (অনন্যা) ওই বাড়িতে আসেন, আরও একটু পরে সুদূর আমেরিকা থেকে ছেলে ও বৌমা (মানসী) ঢুকে পড়ে শুরু হয় সম্পত্তি নিয়ে ভাগ বাটোয়ারার গল্প!
ছবির স্মার্ট সম্পাদনা, আবহ এবং সুন্দর ও শৈল্পিক ভাবে রবীন্দ্র গানের ব্যবহার! ছবিকে অন্যমাত্রা এনে দেয়। তবে এই ছবি থেকে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি প্রতিটি শিল্পীর জীবন্ত অভিনয়!অলকনন্দা রায়, অপরাজিতা আঢ্যকে পাশে আলাদা করে নজর কেড়েছেন পিংকি চরিত্রে শিল্পী অনন্যা। সৌরসেনীও অভিনয়ও নজর কেড়েছে। তবে বেশ খারাপ লাগল ফিল্ম পরিচালকের ভূমিকায় কৌশিক সেনকে। অভিনয় দেখানোর কোনও সুযোগই তিনি পেলেন না। প্রোডাকশন কন্ট্রোরালের চরিত্রে বিশ্বনাথ বসু শুধুই হাসির খোরাক হয়ে রইলেন।
“একান্নবর্তী” র দুর্বল জায়গা – ছবির শুটিং হচ্ছে, হৈ হৈ করে, কিন্তু ছবির বিষয়টা কী, বা এই বাড়ির সঙ্গে কী যোগ সেটা পরিষ্কার নয়। একটা খুনের গল্প রয়েছে, আবছা বোঝা গেলেও, তার বেশি নয়। সিনেমার গল্পের সঙ্গে এই বাড়ির গল্পর একটা সমন্বয় ঘটাতে পারলে ভাল হত মনে হয়। পরিচালক ও সহকারীর সঙ্গে মা ও মেয়ের বন্ধুত্ব তৈরির গল্প তাই তেমন জোরাল হয়ে ওঠে না।