সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: মাঘ শেষ হতে প্রায় এক পক্ষ কাল বাকি। ভালোবাসার দিন আসতেও সপ্তাহ দুয়েক। কিন্তু তার আগেই কুঁড়ি ফাটিয়ে লাল পলাশে রাঙা পুরুলিয়া। বনমহলের এই জেলার একাংশে ফেব্রুয়ারির গোড়াতেই একেবারে পলাশময়। তবে বৃহস্পতিবারের বৃষ্টিতে পলাশ খানিকটা ঝরে পড়ে। তবুও ‘পিন্দারে পলাশের বন…।” ভরা শীতেই যেন পুরুলিয়ায় ভালোবাসার আগুন ঝরাচ্ছে লাল পলাশ। তাই মনও উড়ুউড়ু।
কিন্তু মাঘেই এমন রাঙা পলাশ কেন? মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এমন অবস্থা। বলছেন বনাধিকারিক থেকে উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞরা। গত তিন-চার বছর ধরেই এই ছবি দেখা যাচ্ছে পুরুলিয়ায়। জলবায়ু পরিবর্তন বলতে একদিকে যেমন উষ্ণতা, শুষ্কতা। তেমনই অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, মাটিতে জলের পরিমাণ কমে যাওয়া। তাই ক্যালেন্ডারে বসন্ত না এলেও লাল পলাশে পুরুলিয়ার প্রকৃতিতে বসন্ত যেন চলে এসেছে মাঘেই। তাই উচ্ছ্বসিত এই জেলার প্রকৃতিপ্রেমীরা।
ইতিমধ্যেই মাঘের লাল পলাশের ছবি সামাজিক মাধ্যমে ঘুরছে। আর তা দেখে বসন্তের ট্যুর প্ল্যান এগিয়ে আনছেন ভ্রমণপিপাসুরা। অযোধ্যা পাহাড়ে একটি চার তারা রিসোর্টের জেনারেল ম্যানেজার সুদীপ্ত কুমার বলেন, “ফি বছরই পুরুলিয়ায় পলাশ দেখতে, বিশেষ করে অযোধ্যা পাহাড়ে ব্যাপক ভিড় জমে পর্যটকদের। গত দু’-তিন বছরে সেই সংখ্যাটা ব্যাপক হারে বেড়ে গিয়েছে। দোল পূর্ণিমার সময় যে এই জেলায় সবচেয়ে বেশি পলাশ থাকে, তা কিন্তু নয়। দোল পূর্ণিমা কিছুটা পরে হলে পলাশের ভরপুর সময়ে শুধুমাত্র এই লাল পলাশ দেখতেই আগেভাগে ভিড় জমান পর্যটকরা। তাই পর্যটকরা আগে থেকেই খোঁজখবর শুরু করতে থাকেন। অন্যান্য বারের চেয়ে এবার অনেকটা আগেই পলাশ ফুটে যাওয়ায় ‘বসন্ত স্পেশাল’ রুম বুকিং হতে শুরু করেছে।”
যদিও দোল পূর্ণিমা ২৫ শে মার্চ। এখনও প্রায় দু’মাস। ইদানীং এই লাল পলাশের টানে বিদেশি পর্যটকরাও পুরুলিয়ায় পা রাখছেন। কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে বসন্তে বোলপুর- শান্তিনিকেতনের রুট বদলে ভ্রমণ প্রিয় বাঙালিরা পুরুলিয়া আসছেন। ফলে পুজো ও শীতের মরশুমের মতোই এখানকার সরকারি অতিথি আবাস, হোটেল, লজ, রিসোর্ট, কটেজ সমস্ত হাউসফুল হয়ে যায়। যার বুকিং শুরু হয়ে গিয়েছে জানুয়ারির শেষ থেকেই।
আসলে এবার ২২ জানুয়ারির সময় থেকেই পলাশ ফুটতে শুরু করেছে পুরুলিয়ার বিভিন্ন জঙ্গলে। বলরামপুর বনাঞ্চলের ঘাটবেড়া থেকে কোটশিলার সিমনি। যেন চারদিকই পলাশময়। অর্থাৎ শুধু অযোধ্যা পাহাড়তলি নয়। ঝাড়খণ্ড ছুঁয়ে থাকা ঝালদা দুই ব্লকের বিভিন্ন জায়গাতেও রাঙা পলাশে জঙ্গল যেন আরও চোখ টানছে। পুরুলিয়ার সিধো-কানহো-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিদ্যার বিভাগের প্রধান সুব্রত রাহা বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এমন অবস্থা। পুরুলিয়ার বেশ কিছু গাছে লাল পলাশ দেখা যাচ্ছে। যে অঞ্চলগুলো শুষ্ক, যেখানে মাটিতে জলের পরিমাণ কম, সেখানেই আগেভাগে পলাশ দেখা মিলছে।”
কংসাবতী দক্ষিণ বিভাগের ডিএফও অসিতাভ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “বেশ কয়েক বছর ধরেই পুরুলিয়ায় ভরা শীতেই পলাশের দেখা মিলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এমন অবস্থা।” তবে এবার যে শীত নেই তা কিন্তু নয়। গত ১৫ই জানুয়ারি মকর সংক্রান্তির দিন এই জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৫.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে নেমে গিয়েছিল। ফলে কালিম্পং, গ্যাংটকের সঙ্গে রীতিমতো পাল্লা দিচ্ছিল। যদিও এই জেলার সর্বনিম্ন চারের ঘরে নেমে যাওয়ারও রেকর্ড রয়েছে একাধিকবার।
[আরও পড়ুন: মালদ্বীপকে সাহায্য করবে দেউলিয়া পাকিস্তান! এ কী বলছে ইসলামাবাদ?]
আসলে এবার শীতটা ছিল একেবারে স্থায়ী। তাই দীর্ঘদিন ছিল কাঁপুনি। কিন্তু পশ্চিমী ঝঞ্ঝায় এই জেলায় উল্লেখযোগ্য ভাবে আবহাওয়ার রদবদল হয়। বিশেষ করে জেলার যে অংশ শুষ্ক সেখানেই কার্যত আগুন ঝরাচ্ছে লাল পলাশ। ২০২২ সালে ডিসেম্বরের শেষের দিকে পলাশের কুঁড়ি দেখা গেলেও ফুল ফুটতে এবারের চেয়ে দেরি হয়। এবার যেভাবে জানুয়ারি শেষ না হতেই পুরুলিয়ার একাংশ লাল পলাশে ছেয়ে গিয়েছে। তাতে ক্যামেরাবন্দি করতে ফটোগ্রাফাররাও ভিড় জমাচ্ছেন।
গতবার এই জেলাতে হলুদ পলাশও ফুটেছিল ব্যাপকহারে। তবে তা গুটিকতক জায়গায়। দেখা মিলেছিল শ্বেত পলাশেরও। যদিও তাকে ঘিরে বিতর্ক কম হয়নি। উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞদের একাংশ তাকে শ্বেত পলাশ বলতে রাজি হননি। তবে এই পলাশকে ঘিরে বাণিজ্য হয়ে গিয়েছিল জমজমাট। আসলে পুরুলিয়ার পলাশ এখন পর্যটনের অন্যতম অঙ্গ। এমন আগুন ঝরানো পলাশ যে আর কোথাও দেখা যায় না!