সেই স্বর্ণযুগ, ইতিহাস এখন শুধু মলাট বন্দি। কিন্তু গ্রিসের বর্তমান সমাজে শিক্ষা দর্শনের বৈভব চোখে পড়ে না। ঘুরে এসে লিখছেন শতরূপা বোস রায়৷
গ্রিক গডেস অফ উইসডম হলেন এথেনা। সেই থেকেই নামকরণ এথেন্স শহরের। ৫০০০ বছর আগে পাশ্চাত্য সভ্যতার ভিত স্থাপনা হয়েছিল এই গ্রিসে। অ্যাক্রোপলিস নামে এক পাথরের টিলার ওপরে প্রথম এথেনা শহরের স্থাপত্য। তারপর সময়ের বহমানতায় প্রাচীন এই শহর সাক্ষী থেকে গেছে একের পর এক পরিবর্তনের, একের পর এক প্রগতির। ইতিহাস, দর্শন, থিয়েটার, পলিটিকস, আর্কিটেকচার, পটারি, ম্যাথমেটিক্স এই শহরের বুকের ওপরেই এই সব কিছুর র্যাডিক্যাল ভার্সন তৈরি হয়েছে যা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সেই স্বর্ণযুগের ইতিহাসের ছায়া, সেই প্রাচীন ইতিহাস বইয়ের পাতায় আটকে পড়ে আছে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অ্যাক্রোপলিস দাঁড়িয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু গ্রিসের বর্তমান সমাজে সেই শিক্ষার, দর্শনের, চারুশিল্পের সেই বৈভব চোখে পড়ে না আর।
দ্বীপ ভ্রমণ: ইউরোপ থেকে যাঁরা গ্রিস বেড়াতে যান তাঁরা এথেন্স দেখতে যায় না। যান গ্রিসের দ্বীপগুলোতে। ইজিয়ান সি এর উপরে অবস্থিত এরকম অনেক দ্বীপ আছে গ্রিসে। ছোট ছোট নাম না জানা। তার মধ্যে সবচেয়ে যেখানে টুরিস্ট সমাগম হয় তা হল স্যান্টোরিনি আর ক্রেটা। ক্রেটা আইল্যান্ডটি বেশ বড়। দুটো বিমানবন্দর আছে ক্রেটায়। তাছাড়া বিশাল পোর্ট। বাণিজ্যিক দিক দিয়ে দেখতে হলে গ্রিসের অন্যতম ব্যস্ত পোর্ট হল ক্রেটা। স্যান্টোরিনি সহ অন্য ছোট ছোট আইল্যান্ডগুলোতে এই ক্রেটা থেকেই আমদানি রপ্তানি হয়। স্যান্টোরিনি ক্রেটার তুলনায় অনেক ছোট। স্যান্টোরিনি গ্রিসের আইডিয়াল রোমান্টিক আইল্যান্ড হিসেবে বিখ্যাত। ইজিয়ান সিয়ের জলের রংটা গাঢ় নীল। তার পাশে সাদা রঙের সিমেন্টের ছোট ছোট বাড়ি। বাড়ির মাথাগুলো গোল। ডোমের মতো। সব মিলিয়ে ৪/৫টা বিচ আছে এই স্যান্টোরিনিতে। ইজিয়ান সিয়ের জলের রং মেডিটেরেনিয়ান এর থেকে অনেক বেশি গাঢ় নীলচে। এই আইল্যান্ডে সব মিলিয়ে ৩/৪ টে গ্রাম আছে। তার মধ্যে ওইয়া হলো প্রধান। পাহাড়ের গা বেয়ে রাস্তা ওপরে নিচে। সেই শুরু রাস্তা বেয়ে একটা গ্রাম থেকে আরেকটা গ্রাম এ যাওয়া যায়। সবটাই সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে। সিন্যারোটিনি আইল্যান্ড থেকে সমুদ্রে তাকালে যেটা সর্বপ্রথম চোখে পড়ে তা হল অজিয়ানের নীলজলের ওপরে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা একটা ভলক্যানো। ডরমেন্ট এই ভলক্যানোর পাশেই স্যান্টোরিনি আইল্যান্ড। ডিঙি নৌকা করে আইল্যান্ড থেকে ওই ভলক্যানোর ভেতরেও যাওয়া যায়।
কোল্ড বিয়ার…রঙিন মন: ইউরোপের বিচ চিন্তা করলেই মনে হয় নীল জল, সাদা ক্লিফ, লালচে বালি, বিচ চেয়ার, ঠান্ডা বিয়ার আর সান বেদিং। শেষের ছবিটার সঙ্গে মিলে আছে রঙিন মনের বাহারি কল্পনা। না জানি কী রোমহর্ষক সেই ইউরোপীয় রমণীদের সান বেদিং এর দৃশ্য। কিন্তু স্পেনের কিছু কিছু ন্যাচারাল বিচে গেলে সেই কল্পনার বাস্তবিক রূপ দেখা যায় ঠিকই। কিন্তু স্যান্টোরিনি সেরকম নয়।
রোমান্টিক ওইয়া: আকাশের গায়ে ডুবে যাওয়া সূর্যের লাল আভা। সাদা ধপধপে সমুদ্রের পাশের ওই ডোমগুলোর ওপরে যখন নিভে যাওয়া সূর্যের শেষ রংটুকু লেগে থাকে তখন সবটা কেমন যেন সোনালি দেখায়। প্রকৃতির এই রঙের মেলা দেখা জীবনের জয়গান গাইতে ইচ্ছে করে। নতুন করে আবার মুগ্ধতায়, বিস্ময়ে বাঁচতে ইচ্ছে করে। দিগন্ত জোড়া আকাশ আর জলরাশির এই রঙিন মিলন কেবল এসে যেন কানে কানে বলে দিয়ে যায় জীবনকে নতুন করে ভালবাসতে। তাই হয়তো স্যান্টোরিনির এই ওইয়া আইল্যান্ড পৃথিবীর রোমান্টিক জায়গাগুলোর মধ্যে একটি। কিন্তু বছরের মাত্র কয়েকটা দিন। জুন মাস থেকে সেপ্টেম্বর অবধি। তারপরই এই ইজিয়ান সিয়ের অন্য রূপ। লোকাল লোক যারা ওখানে হোটেলের ব্যবসা করে তারা বলে এই সমুদ্র গরমের সময়টুকু এরকম কিন্তু শীতের শুরুতে বা শীতকালে এর ভয়াল রূপ দেখা যায়। স্যান্টোরিনির সঙ্গে তখন মেন ল্যান্ডের সকল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। শীতের আগেই তাই এখান কার লোকাল লোক বেশির ভাগ এই আইল্যান্ড ছেড়ে চলে যায়. যারা থাকে তারা বেশির ভাগ সময় বাড়ির মধ্যেই থাকে। পাথরের রাস্তা দিয়ে পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে নামা বা ওপরে ওঠা কোনওটাই সে সময় নিরাপদ নয়। সাদা আর নীল রং স্যান্টোরিনির প্রতীক। মাঝে মাঝে চোখ সয়ে গেলে পাহাড়ের কোলে নাম না জানা ফুলের দিকে তাকিয়ে নিতে হয় শুধু। বেশির ভাগ বাড়িতে বোগেনভেলিয়া গাছগুলো ফুলের ভারে নুয়ে পড়েছে। সাদা সিমেন্টের স্তম্ভ, আর নীল জল যেন একে অপরের সঙ্গে কথা বলে চলে সর্বক্ষণ। এই নাম না জানা নানা রঙের ফুলগুলো মনে হয় ওদের এই নিবিড় বন্ধুত্বে আড়ি পাতছে। ওইয়ার দিকটাই একমাত্র টুরিস্ট অ্যাট্রাকশন। বাকিটা এখনও রাগেড। লাল পাথর এবড়োখেবড়ো রাস্তা। জনবসতি নেই বললেই চলে। বেকারত্ব সারা দেশ জুড়ে কিন্তু স্যান্টোরিনিতে যেন আরও বেশি। চোখে লাগে। তবুও মানুষগুলো বড় অন্য রকম। রেস্টুরেন্টে গেলে পাত পেড়ে বসে খাওয়াবে, বার বার এসে জিজ্ঞেস করে যাবে আরেকটা পিটা ব্রেড হোমোসের সঙ্গে দেবে কিনা। গ্রিক স্যালাড সঙ্গে মোজারেলা চিজ যতবার ইচ্ছে টেবিলে দিয়ে যাবে। অলিভ অয়েল তো আছেই সঙ্গে। এরকম খারাপ ইকোনমির মধ্যেও আহারের বাহার। গ্রিক গাইরোস এর নাম হয়তো না সবাই জানেন।… শ্রেডেড চিকেনের সঙ্গে স্টার ফ্রাইড ভেজিটেবলস। সেই সঙ্গে ফেটা চিস আর অলিভ অয়েল। সবে মিলে এরকম সহজ সুস্বাদু খাবার মেইনল্যান্ড ইউরোপের কন্টিনেন্টাল ডিশগুলো মধ্যে যেন সবার সেরা।
তবুও প্রাণোচ্ছল: ইউরোপীয় ইতিহাসের সূচনা এই দেশে। কিন্তু বর্তমানে ইউরোপীয় অন্য সব দেশগুলোর থেকে গ্রিস পিছিয়ে। এদের এখন একমাত্র ইকোনমি হল টুরিজম। এ ছাড়া বেকারত্ব সারা দেশ জুড়ে। তাই এথেন্স শহরে যাবার আগে স্যান্টোরিনি হোটেল থেকে সাবধান করে দেয়। টিকালো নাক, গোলাপ ফুলের মতো গায়ের রং, অ্যাভারেজ হাইট ৬ ফুট। বেশিরভাগ পুরুষের লম্বা চুল, ঘাড়ের কাছে একটা ঝুঁটি বাঁধা। গ্রিক পুরুষের দিকে তাকালে চোখ সরানো দায়। সবাই হয়তো বা জিউসের বংশধর। রাজবংশীয় হলেও এদের দেশে কাজ নেই। এতটাই গরিব এরা যে দিনের পর দিন পিটা ব্রেড আর হোমস খেয়ে কাটিয়ে দিতে পারে। তবুও প্রাণোচ্ছল সর্বদা হাসছে এরা। এরকম টুরিস্ট ফ্রেন্ডলি দেশ ইউরোপের অন্য কোনও
শহর বা দেশ নয়।
নীল রঙের সঙ্গে জীবনের একটা অদ্ভুত মিল… আমাদের আসা যাওয়ার পথের রং তা হয়তো বা নীল বলে? তাই গ্রিসের স্যান্টোরিনির এজিয়ান সিয়ের নীল রং জীবনের সব রংকে ধূসর করে দিতে পারে।…
The post বছর শেষে পাড়ি দিন ‘অন্য গ্রিসে’ appeared first on Sangbad Pratidin.