shono
Advertisement

Breaking News

Manoj Mitra

'মাটি বলে আমারে সাজাও...' বাংলা থিয়েটারেও ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধের নাম মনোজ মিত্র

'মৃত্যুর চোখে জল' থেকে 'সাজানো বাগান', মনোজ মিত্রের অসংখ্য নাটকে উঠে আসে তাঁর ছোটবেলার স্মৃতি।
Published By: Arpan DasPosted: 05:26 PM Nov 12, 2024Updated: 09:31 PM Nov 12, 2024

অর্পণ দাস: "মাটি বলে আমারে সাজাও... নিষ্কাম সাজাও!..."
'সাজানো বাগান' নাটকে বাঞ্ছা কাপালির সংলাপ।
মাটি, মাটির খোঁজ। বাংলা থিয়েটারের সাজানো মঞ্চেও মনোজ মিত্র অবিরাম খুঁজে চলেন একটুকরো মাটির স্পর্শ। সেই খোঁজ কি আজকের? অবিভক্ত ভারতবর্ষের খুলনা থেকেই প্রবহমান এক স্রোত মাটির গন্ধ ধরে গজিয়ে ওঠে থিয়েটারের গায়ে গায়ে। সেই স্রোত কপোতাক্ষ জলে ভেসে এসে পড়েছে কলকাতায়। তার সুরভী ছড়িয়ে পড়ে ভারতবর্ষের কোনও এক নাম না জানা গ্রামের পোড়ো জমিতে। কিংবা উঁকি দিয়ে ঢুকে পড়ে শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনের ঘরকন্নায়। মনোজ মিত্রকে যে কত রূপে, কত আবিষ্কার করা যায়!

Advertisement

খোঁজ শুরু করা যাক সেই সাতক্ষীরার সেই ছোটবেলা থেকেই। তখনই ঠিক করে নিয়েছিলেন বড় হয়ে কী হবেন। না, থিয়েটার, সিনেমায় দাপটে ঘুরে বেড়ানোর কথা ভুলেও ভাবেননি। তখন তাঁর পরিকল্পনা ছিল আট-দশ রকম। স্মৃতিকথায় বলছেন, "জেলে হয়ে মাছ ধরব। তাঁতি হয়ে তাঁত চালাব। স্যাকরা হয়ে গয়না গড়াব। কুমোর হয়ে মাটির হাঁড়ি গড়াব। রাখাল হয়ে গোরু চড়াব। ফকির হয়ে গাজনপিরের গান গাইতে পারি।" কে জানত, একদিন নাটককার মনোজ মিত্রের চর্চা অফুরন্ত ভাণ্ডার নিয়ে আসবে বাংলা থিয়েটারে।

ঠিক কোন সময়ে? স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা থিয়েটারের সরেজমিনে তদন্তে একটা কথা বারবার উঠে আসে। তা হল, দেশি-বিদেশি নাটকের অনুবাদে সাজান ফুলমালা। চেকভ থেকে পিরানদেল্লো, ইবসেন থেকে ব্রেখট, প্রত্যেকেই উপস্থিত বঙ্গরঙ্গমঞ্চের আলোর সামনে। কখনও সেটা অতীত থেকে সমসাময়িকে চলে আসে সফোক্লেসের হাত ধরে। কখনও বা ইয়নেস্কোদের 'কিমিতিবাদী' চর্চায় তুলে দেয় মূল্যবোধ নিয়ে হাজারও প্রশ্ন। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপল দত্তদের থিয়েটারি ভাবনায় 'ভালো নাটক, ভালোভাবে করার' সঙ্গে সোচ্চার হয়ে উঠছে সম্ভাব্য বিপ্লবের স্বপ্ন। রবীন্দ্রনাথ থেকে সফোক্লেসের 'অন্ধকারের নাটকে' অবাধ বিচরণ শম্ভু মিত্রের। গ্রামীণ জনজীবনের সঙ্গে আর্কেটাইপের সন্ধান নিয়ে কিছুটা ভিন্নপথে চলেছেন বিজন ভট্টাচার্য।

সেই সময় ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় মনোজ মিত্রের 'চাক ভাঙা মধু'। উচ্চস্বরে দিনবদলের স্লোগান নেই, নেই গণআন্দোলনের চড়া সুর। শুধু নাটকের শেষে বাদামী অস্ত্র হাতে ছুটে আসে গ্রামের আলপথ ধরে। ভবিষ্যতে অত্যাচারিত হবে জেনেও মৃতপ্রায় অঘোর ঘোষকে বাঁচানোর জন্য সে লড়ে যায় অবিরত। অন্যদিকে হাসি-মজার ছাঁচের মধ্যে দিয়ে বাঞ্ছারামের বাঁচার প্রতিবাদ। যে সিনেমার চিত্রনাট্য শুনে গৌরকিশোর ঘোষ পরিচালক তপন সিংহকে বলেন, "আরে তপন, তুমি বলেছিলে, সামান্য একটা হাসির স্ক্রিপ্ট শোনাবে? এ যদি হাসির ছবি হয় তবে লড়াইয়ের ছবি কোনটা, অস্তিত্বের সপক্ষে সংগ্রামের ছবি কোনটা?"

শুধু একক ব্যক্তির 'অস্তিত্বের' লড়াই নয়, জড়িয়ে যায় বৃহত্তর জনতার ছবিও। যারা উঠে আসে বাংলার জনজীবনের গভীর থেকে। সোঁদা মাটির গন্ধ শোনা যায় মনোজ মিত্রের নাটকে। গল্প হেকিমসাহেব, দেবী সর্পমস্তা, দর্পণে শরৎশশী-সহ অসংখ্য নাটকে রয়েছে এই জীবনের কথা। কখনও তা ইতিহাসের আবরণে, কখনও-বা রূপকথার ছোঁয়ায়। রবীন্দ্রনাথের নাটক যেভাবে 'প্রাচ্যদেশের ক্রিয়াকর্ম খেলা-আনন্দ সমস্ত সরল-সহজ' খুঁজে বেড়ায়, গ্রুপ থিয়েটারের আদলে তার একটা বিশেষ রূপ ধরা পড়ে মনোজ মিত্রের থিয়েটারচর্চায়। ভিড় করে আসে গঞ্জের মানুষ। যেমন তাঁর ঠাকুরদা কিছুতেই নগদ টাকা ব্যয় করতে চাইতেন না। বাকি সব কিছু ধানচালের বিনিময়ে। সবসময় হৃদযন্ত্রের টিকটিক শুনে যেতেন। ঠাকুরদার ভিতরের সেই গোপন হাসিকান্না থেকেই তৈরি হয় 'মৃত্যুর চোখে জল' নাটক। 'সুন্দরম'-এর প্রযোজনায় পার্থপ্রতিম চৌধুরি নির্দেশিত সেই নাটকে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন মনোজ মিত্র। পরে অবশ্য সুন্দরম ত্যাগ করেন। মাত্র এক বছর গন্ধর্ব সংস্থার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।

আর বাঞ্ছা? সেও তো বাস্তব চরিত্র। মনোজ মিত্র নিজেই লিখছেন, "নদীর কূলে কাপালি পাড়ায় এক বুড়ো চাষীর ছিল মস্ত পান সুপুরিবাগান। বুড়োর গায়ের রঙ সাদা ফকফকে। হাঁটু-মাথায় জোট বেঁধেছে বুড়োর, বসে বসে চলাফেরা করে। ৬৩ কত বয়েস কে বলবে। কোনোদিন বাগান ছেড়ে বাইরে বেরত না। সবসময় হয় উঠোনে, নয় পানবরজে ঢুকে বসে খুচখাচ কাজ করত। কথাও বলত না বেশি। কেউ পান সুপুরি কিনতে এলে পয়সাটি নিত, মাল দিত। কথা নেই। পুজোর সময় শুধু গোরুর গাড়িতে চেপে আমাদের পুজোর মেলায় কেনাকাটা করতে আসত। ঠাকুমা বলত, ও বাঞ্ছা এখনো বাগান সাজাচ্ছ? বুড়ো ফিক ফিক করে হাসত। উত্তর দিত না।" মঞ্চের সাজানো বাগান থেকে সিনেমার বাঞ্ছারাম। ছোটবেলার স্মৃতি-বিস্মৃতি বাস্তব হয়ে ওঠে মনোজ মিত্রের কলমে-অভিনয়ে।

কথায় কথা বাড়ে। দীর্ঘ হতে থাকবে উদাহরণের তালিকা। বৃষ্টি নামে কপোতাক্ষ জলে। থেমে যায়, ভেসে যায় গঙ্গার দুপ্রান্ত ধরে। উদ্বাস্তু এক মানুষের নাটকে চেনা-অচেনা বাংলার সোঁদা মাটির গন্ধের আঘ্রাণে মত্ত হয় বাংলা থিয়েটার। সময়ের টানে কিছুটা ফিকেও হয় বোধহয়। তিনি মহাপ্রস্থানে গমন করেন, কিন্তু মহাবিশ্বে কিছুই হারায় না। শেষবেলাতেও শোনা যায় সেই অমোঘ-নিষ্কাম উচ্চারণ 'কতোবার তো মরতি যাই! ওরা যে কিছুতে ছাড়ে না! আমার গাছপালা.... নাতিপুতি পুঁইপোনা....সব মাথা ঝাঁকায়.... বলে বুড়ো, তোমা হতে আমরা সব হয়েছি... তুমি আমাদের নক্ষে করেছো...' শিকড়হারা হয়ে নিজে আজীবন মাটি খুঁজেছেন। বাংলা থিয়েটারের সেই মাটির স্বাদ আপনার হাত ধরে চিরদিন 'রক্ষা' পাক মনোজ মিত্র।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • অবিভক্ত ভারতবর্ষের খুলনা থেকেই প্রবহমান এক স্রোত মাটির গন্ধ ধরে গজিয়ে ওঠে থিয়েটারের গায়ে গায়ে।
  • সেই স্রোত কপোতাক্ষ জলে ভেসে পড়েছে কলকাতায়।
  • তার সুরভী ছড়িয়ে পড়ে ভারতবর্ষের কোনও এক নাম না জানা গ্রামের পোড়ো জমিতে।
Advertisement