নির্মল ধর: ষাট বছর আগে মুক্তি পাওয়া সত্যজিৎ রায়ের (Satyajit Ray) অন্যতম সেরা ছবি ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’র সঙ্গে এই শুক্রবার মুক্তি পাওয়া রাজর্ষি দের ‘আবার কাঞ্চনজঙ্ঘা’র (Abbar Kanchanjangha) কোনও যোগসূত্র নেই। যেমনটি ছিল ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র সঙ্গে ‘আবার অরণ্যে’র। দু’টো ছবির একমাত্র কমন ফ্যাক্টর কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড়টি। সত্যজিতের পুরো ছবিতে ওই পাহাড়টি এক প্রতীক। দেখা যায় মাত্র একটিবার ছবির শেষে। তাও দর্শক দেখেন, ছবির কোনও চরিত্রই দেখতে পায় না। শুধু ছবির নয়, চরিত্রগুলোর অন্তর্নিহিত ট্রাজেডিও এই অদেখার মধ্যেই রেখে দেন সত্যজিৎ রায়। রাজর্ষির এই ছবি কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ব্যবহার করেছে বারবার। সংলাপে তো এসেছেই, ছবির শেষেও রয়েছে। বিশেষ করে বিষাদঘন দৃশ্যে, যেখানে প্রধান চরিত্র সুমিত্র যেন কাঞ্চনজঙ্ঘার সামনে দাঁড়িয়ে সদ্য শোকের মধ্যে শান্তির আশায়, স্মৃতির কাছে ফিরতে চায়।
এক পরিবারের এক বোন (অর্পিতা) ও চার ভাই (কৌশিক, পদ্মনাভ, রাহুল এবং গৌরব)। তাঁদের পৈতৃক একটি প্রাসাদোপম বাড়ি আছে দার্জিলিঙে। বড় ভাই ত্রিদিব (কৌশিক সেন) ও বড় বউ (বিদীপ্তা চক্রবর্তী) দু’জনেই এই দেব পরিবারের কর্তা। মেজ সুদেব পারিবারিক ব্যবসায়, সেজ দেবেশ মাথাগরম এক উঠতি রাজনীতিবিদ, ছোটজন রোহিত ভাগ্যান্বেষণে মুম্বাইতে ফিল্মের স্ক্রিপ্ট লেখে। প্রত্যেকেই বিবাহিত, একমাত্র রোহিত বিয়ে না করে লিভ-ইন করে অবাঙালি অ্যাঞ্জেলিনার (দেবলীনা কুমার) সঙ্গে। একমাত্র বোন সেমন্তী বিয়ে করে দিল্লিবাসী নামী, পরিচিত এবং প্রভাবশালী সাংবাদিক সুমিত্রকে (শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়) । তিনি শ্যালক দেবেশের কাজকর্ম নিয়ে যথেষ্ট বিরক্ত। সেজন্য দু’জনের মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন দূরত্বও রয়েছে। মেজভাইয়ের তরুণী মেয়ে রীতজার আবার ‘ক্রাশ’ রয়েছে পিসেমশাই সুমিত্রর ওপর। কারণ দিল্লির জেএনইউ-র ছাত্র ছিলেন সুমিত্র। রীতজার পছন্দের কলেজও জেএনইউ (JNU)। আরও একাধিক চরিত্রের মধ্যে অতীত প্রেম দেখানো হয়েছে।
[আরও পড়ুন: কোটি টাকার লটারি পেয়েই বাড়ি থেকে উধাও, রাতভর কলাবাগানে লুকিয়ে দিনমজুর!]
বড় বোন এবং আরও অনেকেরই বিশ্বাস দার্জিলিংয়ের বাড়ি ‘অভিলাষ’-এ এক জাদু আছে, ওখানে গেলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। সুতরাং প্রায় বড় বোনের ইচ্ছেতেই সকলে বছর শেষ ক’টা দিন কাটাতে এক মেগা ফ্যামিলি রিউনিয়নেরর পরিকল্পনা হয়। বিশ বছর বাদে ‘আবার কাঞ্চনজঙ্ঘা’র সামনে ‘অভিলাষ’-এ মিলিত হয় সবাই। এখানেই ধীরে ধীরে বেআব্রু হতে থাকে প্রত্যেকের লুকিয়ে রাখা অতীত, স্মৃতির ব্যথা, সংসারিক বিরোধ, সম্পত্তি বিক্রি নিয়ে চরম মতানৈক্য। যেখানে প্রায় উদ্ধারকর্তার ভূমিকা নেন বাড়ির বড় জামাই সাংবাদিক সুমিত্র।
সিনেমা যখন, সমস্যার সমাধান হবেই। পদ্মনাভর চিত্রনাট্য সুন্দরভাবেই বুনেছে অগুনতি ঘটনা ও চরিত্রের জটিলতা, রাগ, অভিমান, অনুযোগ। বিশেষ করে বদরাগী নেতা দেবেশের কাণ্ড-কারখানা। পনেরোটি চরিত্রকে ঠিকঠাক জায়গা দিতে গিয়ে ছবির দৈর্ঘ্য বেড়েছে। আবার একই সঙ্গে মনে হয়েছে সব চরিত্র সমান গুরুত্ব পেল না বুঝি। পারস্পরিক সম্পর্কগুলো অনেকাংশেই লেগেছে সাজানো। ভাল-মন্দ মিশিয়ে শেষপর্যন্ত সকলেই ভাল। এটা কতটা স্বাভাবিক এবং বাস্তব, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়।
অনসম্বল কাস্ট নিয়ে তৈরি এই ছবি দেখতে হয় শুধুমাত্র নামী ও অনামী শিল্পীদের দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য। ছবির মেরুদণ্ড শাশ্বত এবং অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়। দু’জনের চারিত্রায়নই জীবন্ত ও বাস্তব। রাহুল, তনুশ্রী, বিদীপ্তা, গৌরব, কৌশিক, এমনকী ছোট্ট মেয়ে রঞ্জিতা দাস, অল্প পরিসরে রূপঙ্কর বাগচী, সোনালী গুহ রায়, রিচা শর্মা, দেবশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়, দেবলীনা কুমার, সক্কলেই প্রয়োজনমাফিক অভিনয় করেছেন ক্যামেরার সামনে। বিদীপ্তা, তনুশ্রী ও রাহুলকে বাড়তি একটু নম্বর দেওয়াই যায়। উজ্জয়িনী ও অনুপম রায়ের গান, বিশেষ করে শেষ পর্বে “মেঘ বলেছে যাবো যাবো….” এবং “দেখো সখা ভুল করে ভালবেসো না…” যেন ছবির অন্তরটুকু ধরিয়ে দেয়। তারকাখচিত এই বাংলা ছবি ব্যবসা কী, বা কেমন করবে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু অভিনয় দেখার জন্য একবার হলমুখী হলে নিরাশ হবেন না দর্শক।
সিনেমা – আবার কাঞ্চনজঙ্ঘা
অভিনয়ে – শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরব চক্রবর্তী, বিদীপ্তা চক্রবর্তী, তনুশ্রী চক্রবর্তী, পদ্মনাভ দাশগুপ্ত, দেবলীনা কুমার, কৌশিক সেন প্রমুখ
পরিচালনায় – রাজর্ষি দে