অভিরূপ দাস: নবাগত শিল্পী হিসাবেই একটা শো থেকে ৩ হাজার টাকা। বছরে কমপক্ষে তিন লক্ষ টাকা রোজগার পাকা যাত্রাপালা থেকে। এহেন বিনোদন অনুষ্ঠানের নাম শুনে নাক সিঁটকান শহরের বাঙালিরা। সেই যাত্রায় অভিনয় শিখতে চেয়ে আবেদন করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, অধ্যাপক এমনকী স্নাতক পড়ুয়াও। গ্রামগঞ্জ-মফস্বলের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম এখন যে রোজগারের বিকল্প পথ।
১৫ দিন ধরে অভিনয় শেখানো হবে বাগবাজারে পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা আকাদেমিতে (Paschim Banga Jatra Academy)। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানানো হয়েছিল। একের পর এক আবেদনপত্র জমা পড়তে থাকে। ন্যূনতম যোগ্যতার কোনও মাপকাঠি ছিল না। সব আবেদনপত্র জমা পড়তে দেখা গেল যাত্রায় অভিনয় শিখতে চেয়ে আবেদন করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমফিল, গবেষক, স্নাতক এমনকী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রও! তাঁদের এক জনের বক্তব্য, “অভিনয় করতে তো ভালবাসিই। রোজগারটাও প্রয়োজন। যাত্রায় অভিনয় শিখতে চেয়ে তাই আবেদন করেছিলাম। কারণ যাত্রাপালায় অ্যাক্টিং করে প্রাথমিকভাবে বছরে আড়াই থেকে তিন লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব।”
পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা আকাদেমির সচিব তপনকুমার সরকার জানিয়েছেন, অভিনয় শিখতে চেয়ে একশোজন আবেদন করেছিলেন। অডিশনের মাধ্যমে তাঁদের মধ্যে থেকে ৪৩ জনকে বেছে নেওয়া হয়েছে। ১ জুলাই থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত তাঁদের শেখানো হবে যাত্রাপালায় অভিনয়ের খুঁটিনাটি। এঁদের মধ্যে যেমন রয়েছেন কলকাতা এবং তার আশপাশের এলাকার বাসিন্দা। অনেকেই এসেছেন কয়েকশো ক্রোশ দূরের জেলা থেকে। তাঁদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
[আরও পড়ুন: ‘মহাভারত’-এর নাট্যরূপ দেওয়া প্রখ্যাত ইংলিশ পরিচালক পিটার ব্রুক প্রয়াত]
হাওড়ার বালি এলাকার বাসিন্দা সমাঞ্জন মণ্ডল কৃতী ছাত্র। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল করেছেন। গবেষণা করছেন যাত্রা নিয়ে। এহেন সমাঞ্জন অভিনয় শিখতে চেয়ে আবেদন করেছেন। তাঁর কথায়, “যাত্রার জনপ্রিয়তা বিপুল। যাত্রাপালার মধ্যে একটা নীতিগত বিষয় রয়েছে। মানুষের মনে টিভি সিরিয়ালের তুলনায় তা অনেক বেশি দাগ কাটতে সক্ষম।”
জেন ওয়াইয়ের তরুণরাও যে যাত্রাকে রোজগারের মাধ্যম হিসাবে দেখছে তার প্রমাণ মিলছে আবেদনপত্রের দিখে চোখ রাখলেই।
চারুচন্দ্র কলেজ থেকে সদ্য স্নাতক হওয়া সৌরভ দে সরকার যাত্রায় অভিনয় শিখতে চেয়ে আবেদন করেছেন। উত্তর ২৪ পরগনার বারাকপুরের টিটাগড় এলাকার বাসিন্দা অঙ্কিতা সরকারও আবেদন করেছেন যাত্রা শিখতে চেয়ে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে পাস করা বছর তেইশের অঙ্কিতা যাত্রাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করতে চান।
এঁদের সকলকে যাত্রা শেখাচ্ছেন একুশজন শিক্ষক। আগামী ১৪ জুলাই নবাগত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের যাত্রা মঞ্চস্থ হবে ফণীভূষণ বিদ্যাবিনোদ যাত্রামঞ্চে। এই ২০২২ সালে যেখানে ঘরে ঘরে স্যাটেলাইট চ্যানেল, রিমোট ঘোরালেই বিদেশি সিনেমা, মাল্টিপ্লেক্সের অমোঘ হাতছানি, সেখানে যাত্রাপালার জনপ্রিয়তা রয়েছে?
পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা আকাদেমির শিক্ষক মেঘদূত গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, “যাত্রার একটা আলাদা দর্শক আছে। চিরকালই যাত্রাপালাকে বাঁকা চোখে দেখত সমাজের একটা শ্রেণি। যেদিন গিরিশ ঘোষের যাত্রা দেখতে এসে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বিনোদিনীর মাথায় হাত রেখে বলছিলেন ‘চৈতন্য হোক’, সেদিন ওই শ্রেণির যাত্রা বিরোধিতার বিষদাঁতটাই ভেঙে গিয়েছিল। শিক্ষিত শ্রেণির ছেলেমেয়েরা যাত্রা শিখতে চেয়ে আবেদন করছেন, অর্থাৎ যাত্রার জনপ্রিয়তা নতুন প্রজন্মের মধ্যেও রয়ে গিয়েছে।”