বিশ্বদীপ দে: পুজোয় এবার একসঙ্গে চার-চারটে বাংলা ছবি রিলিজ করেছে। সব কটা ছবি নিয়েই কমবেশি আগ্রহ রয়েছে। কিন্তু এরই পাশাপাশি মুক্তি পেয়েছে একটি ওয়েব সিরিজও। সত্যান্বেষী ব্যোমকেশের ‘দুর্গ রহস্য’ (Durgo Rawhoshyo)। একদিকে সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালনায়। অন্যদিকে এটা অনির্বাণ ভট্টাচার্যের শেষ ব্যোমকেশ। তাই আগ্রহ পাক খাচ্ছে এই ওয়েব সিরিজ ঘিরেও। কেমন হল সিরিজটি? এককথায় বলতে গেলে বেশ মনোগ্রাহী। কিন্তু হাল আমলের থ্রিলারগন্ধী রোমাঞ্চ এখানে খুঁজতে গেলে চলবে না। বলা যায়, এই সিরিজে যেন বইয়ের টেক্সটের মতোই যত গল্প এগিয়েছে ততই জমেছে রহস্যের কারিকুরি। আর ক্লাইম্যাক্স তো অনবদ্য।
সম্প্রতি একই কাহিনি নিয়ে ছবি করেছিলেন দেবও। কিন্তু ট্রিটমেন্ট এখানে একেবারেই আলাদা। কেবলই গুপ্তধন খোঁজা কিংবা খুনির সন্ধান নয়, সম্পর্কের নানা দিক এবং মানবমনের চিরচেনা রহস্য দর্শককে নিছক বিনোদনের চেয়ে বেশি কিছুই যেন দেয়। আসলে এই উপন্যাস লেখা হয়েছিল ১৯৫৩ সালে। যদিও সৃজিত সেটাকে প্রায় দুই দশক এগিয়ে এনেছেন। কিন্তু সেই সময়ের বঙ্গজীবনও ছিল আজকের তুলনায় বেশ ধীরগতির। সেই সময়কে প্রতিষ্ঠা করতে গেলেও এটার দরকার ছিল।
এক প্রাচীন দুর্গে লুকনো রয়েছে দেড়শো বছর আগের গুপ্তধন। যার হদিশ মেলেনি আজও।
এদিকে পরিবারে একের পর এক রহস্যময় মৃত্যু। তৃতীয় মৃত্যুটির পরই রহস্য সমাধানে ডাক পড়ে সত্যান্বেষীর। স্ত্রী সত্যবতী ও অভিন্নহৃদয় বন্ধু অজিতকে সঙ্গে নিয়ে ব্যোমকেশ ইনস্পেক্টর পাণ্ডেজির আহ্বানে হাজির হয় সাঁওতাল পরগনায়। ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে যায়, পরিবারের লোকগুলো একসঙ্গে থাকলেও ভিতরে ভিতরে কাজ করছে সম্পত্তির লোভ ও নানা কুটিল রাজনীতি। ব্যোমকেশ অজিতকে নিয়ে দুর্গের একটি ঘরেই বসবাস শুরু করে। এর পর তার সামনে রহস্যের পরত খুলতে থাকে। মোট চারটি মৃত্যু দেখানো হয়েছে। যার মধ্যে তিনজনেরই প্রাণ কেড়েছে সাপের ছোবল। যা ভাবিয়ে তোলে ব্যোমকেশকে। কোথা থেকে আসছে সাপটি? এর পিছনে কি রয়েছে কোনও চক্রান্ত?
[আরও পড়ুন: কুমারী পুজোর রীতি মেনে দুর্গাষ্টমীতে মেয়ে শামিসাকে পুজো করলেন রাজ-শিল্পা, দেখুন]
শেষবার ব্যোমকেশ করতে গিয়ে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন অনির্বাণ (Anirban Bhattacharya)। তিনি একাই যেন এই ৬ এপিসোডের সিরিজের অর্ধেক। কিন্তু বাকিরাও চমৎকার। সোহিনীর (Sohini Sarkar) সঙ্গে তাঁর রোম্যান্স ভালো লাগে। ভালো লাগে বন্ধু অজিতের সঙ্গে মশকরার মুহূর্তগুলি। আলাদা করে বললে স্বল্প সময়েই মুগ্ধ করেন দেবেশ রায়চৌধুরী। চন্দন সেনও যথাযথ। বাকিরাও যে যতটুকু পেরেছেন চিত্রনাট্যের সঙ্গত করেছেন।
তবু আলাদা করে বলার দরকার পড়ে না শেষপর্যন্ত ছবির নিউক্লিয়াস সেই অনির্বাণই। তাঁর চোখের ভাষা, স্মার্টনেস, অসহায়তা সবই এত নিপুণতার সঙ্গে বাঁধা যে তিনি পর্দায় এলে অন্যদিকে চোখ যায় না। ব্যোমকেশ নিজেকে গোয়েন্দা বলেন না। তিনি সত্যান্বেষী। অর্থাৎ অপরাধী ধরার চেয়েও তাঁর আসল কৌতূহল এক সামগ্রিক সত্যের দিকে। সেই অনুসন্ধান অনির্বাণ অভিনীত ব্যোমকেশে আগেও দেখা গিয়েছে। সৃজিতের সিরিজেও তা রয়েছে পরিপূর্ণ ভাবেই।
তবে এই ছবিতে আরও একজন তারকা রয়েছেন। তারকা নন, মহাতারকা। তিনি উত্তমকুমার। সিনেমা হলে ‘চিড়িয়াখানা’ দেখতে এসেছে আসল ব্যোমকেশ। পর্দায় দেখা যায় না। কিন্তু শোনা যায় মহানায়ক অভিনীত ব্যোমকেশের কণ্ঠস্বর, ‘‘হ্যালো, আমার নাম ব্যোমকেশ বক্সী।’’ সঙ্গে সঙ্গে হলজুড়ে সিটির শব্দ ও ‘গুরু গুরু’ ধ্বনি মুহূর্তেই দর্শককে পঞ্চাশ বছর পিছনে নিয়ে চলে যায়। পাশাপাশি নকশাল আন্দোলনকেও কাহিনি কাঠামোর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন সৃজিত। তাই শরদিন্দুর চিরচেনা কাহিনিতে একটা নতুন পরতও এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ফেলুদার সমান্তরালে বার বার ছোট-বড় পর্দায় ফিরতে দেখা গিয়েছে ব্যোমকেশকে। সৃজিতের (Srijit Mukherji) ব্যোমকেশ তাদের মধ্যে অন্যতম হয়ে থাকবে তা বলাই যায়। ‘দশম অবতার’-এর পরিচালক-অভিনেতা জুটি এখানেও তাঁদের ম্যাজিক ছড়িয়েছেন পুরোমাত্রায়।
ওয়েব সিরিজ – দুর্গ রহস্য
অভিনয় – অনির্বাণ ভট্টাচার্য, সোহিনী সরকার, রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়, চন্দন সেন, অনুষা বিশ্বনাথন, সামিউল আলম প্রমুখ
পরিচালক – সৃজিত মুখোপাধ্যায়