বিশ্বদীপ দে: 'তার বয়েস বাড়েনি, এখনও সে মধ্য পঞ্চাশে, থাকে মট লেনেই, বিংশ শতাব্দীর চতুর্থ দশকের কলকাতায়- যে কলকাতা এবং তার পরিবেশ স্বপ্নবৎ মিলিয়ে গিয়েছে।' কার কথা বলা হচ্ছে তা বোধহয় বাঙালি পাঠক বা শ্রোতাকে বলে দিতে হবে না। কেননা মট লেন বললেই অবধারিত ভাবে মনে পড়বে তাকে। সে তারানাথ তান্ত্রিক। বাড়ির গায়ে টিনের সাইন বোর্ডে অবশ্য লেখা তারানাথ জ্যোতির্বিনোদ। শুরুর উদ্ধৃতিটুকু তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'তারানাথ তান্ত্রিক' বইয়ের দ্বিতীয় মুদ্রণের ভূমিকার অংশ। তারানাথের সারাৎসার বোধহয় এই দীর্ঘ বাক্যটির মধ্যেই ধরা আছে। বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন দু'টি। পুত্র তারাদাস অবশ্য অসংখ্য গল্প রচনা করেছেন। এমনকী 'অলাতচক্র' নামের উপন্যাসও। সম্প্রতি তথাগত বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন 'তারানাথের প্রত্যাবর্তন'। যেন এক বৃত্ত পূর্ণ হয়েছে তিনি কলম ধরায়। এবং সেই কাহিনিও বই এবং অডিও স্টোরি- দুই ফর্ম্যাটেই অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ভাবতে বসলে অবাকই হতে হয়। আদ্যিকালের এক আধাসফল তান্ত্রিকের কাহিনি কেন বারবার শুনতে উন্মুখ পাঠক-শ্রোতা? রহস্যটা ঠিক কী? চরিত্র কি কম পড়িয়াছে?
বাবা বিভূতিভূষণের দিগন্তবিস্তারী ছায়ার আড়ালে থেকে গিয়েছে ছেলে তারাদাসের অসামান্য গদ্যের জাদু। কোনও সন্দেহ নেই বাবার দু'টি গল্প যতই উঁচুমানের হোক, ছেলের কলমই কিন্তু চরিত্রটিকে আরও বহু দূর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে।কাহিনির পর কাহিনির মালা সাজিয়ে 'স্বপ্নবৎ মিলিয়ে' যাওয়া এক সময়কে তিনি লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। আট পয়সার পাসিং শো কিংবা শালপাতায় মোড়া গরম বেগুনি-ফুলুরি নিয়ে তারানাথের কাছে পৌঁছয় দুই বন্ধু। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুলেও তারা শুনতে চায় তারানাথের জীবনের অসম্ভব সব গল্প। মাঝে তারানাথের মেয়ে চারি এসে তেল-নুন-কাঁচালঙ্কা দিয়ে মাখা মুড়ি দিয়ে যায়। সঙ্গে চা। এই মজলিশ, এই মৌতাতের মধ্যেই খুলে যায় গল্পের দরজা। কুয়াশামাখা এক সময় উঁকি দেয়। অন্য এক জগতের পর্দাও দুলে ওঠে। রহস্য ও অসম্ভবের সীমানা পেরিয়ে এগিয়ে চলে তারানাথের কাহিনি।
বিভূতিভুষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
কিন্তু কে এই তারানাথ? সম্পূর্ণ কাল্পনিক কোনও চরিত্র? এমনও শোনা যায়, রক্তমাংসের এক মানুষই ছায়া হয়ে মিশে গিয়েছেন কল্পনার অন্দরমহলে। গল্পপটু বন্ধু ষোড়শীকান্তর আদলই কি তারানাথকে তৈরি করেছিল? এমন কথা শোনা যায়। কিন্তু নিশ্চিত করে বলা হয়তো সম্ভব নয়। তবে আড়াল নিয়ে কেই বা ভাবিত? বিভূতিভূষণ তারানাথকে সৃষ্টি করার পর সে 'জীবিত' হয়ে ওঠে। মট লেনের বাসিন্দা হয়েও সে ছড়িয়ে পড়ে দূর থেকে দূরে, পাঠকের হৃদয়ের গহীন অন্দরে।
মাত্র ৫৬ বছর বয়সে প্রয়াত না হলে বিভূতিভূষণ হয়তো তারানাথকে নিয়ে আরও কাহিনি লিখতেন। তারাদাস সেই অভাব পূরণ করলেন। অপু ট্রিলজির শেষ উপন্যাস 'কাজল' লেখার পর তিনি বাবার এই চরিত্রটিকে নিয়েও আখ্যান লিখতে শুরু করেন। এর বাইরেও বহু লেখা লিখেছেন তিনি। কিন্তু নিঃসন্দেহে বলা যায়, তারানাথই তাঁকে প্রকৃত খ্যাতি দিয়েছে। যদিও জীবদ্দশায় তিনি যা খ্যাতি পেয়েছেন, তা অনেকটাই বেড়েছে প্রয়াণের পরে। যত সময় যাচ্ছে সেই জনপ্রিয়তা ঊর্ধ্বমুখী। অডিও স্টোরির সেক্ষেত্রে হয়তো একটা ভূমিকা রয়েছে। যা বাংলা বইবিমুখ আধুনিক প্রজন্মের একটা অংশের কাছেও মট লেনমুখী করেছে। আর সেদিকে লক্ষ রেখেই অনেকে তারানাথের প্যাস্টিশ কিংবা ফ্যান ফিকশন লিখে চলেছেন। সেসব নিয়ে অডিও স্টোরি হয়েছে।
তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
জনপ্রিয় চরিত্রের প্রত্যাবর্তনের নজির পৃথিবীতে আরও আছে। সকলেই জানেন 'দ্য ফাইনাল প্রবলেম' গল্পে শার্লক হোমসকে 'খুন' করেন স্রষ্টা আর্থার কোনান ডয়েল। চাপে পড়ে ফের হোমসকে তিনি কীভাবে ফিরিয়ে এনেছিলেন তাও কারও অজানা নয়। কোনান ডয়েলের প্রয়াণের পরও কিন্তু বেঁচে থেকেছেন শার্লক হোমস। অজস্র প্যাস্টিশ কিংবা ফ্যান ফিকশনে। তার মধ্যে উৎকৃষ্ট সাহিত্যও রয়েছে। কিন্তু তারানাথের নানা প্যাস্টিশে তিনি যেন কেবল নামেই রয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে তথাগত বন্দ্যোপাধ্যায় কলম ধরায় অনেকেই আশ্বস্ত। সেই চেনা কাহিনির টান, হারানো সময়ের জলছাপ! কিন্তু এতদিন পরে কেন? আরও আগে লেখা যেত না?
ফোনে সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালের প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললেন তথাগত। স্পষ্ট জানালেন, ''আসলে আমি অত্যন্ত অলস প্রকৃতির মানুষ। অনেকদিন ধরেই লেখালেখির কথা ভাবি। কিন্তু লিখে ওঠা হয় না। মীর আমাকে অনেকদিন ধরেই বলছিল লেখার কথা। তা একটা অনলাইন অনুষ্ঠানে সেই প্রসঙ্গটা আবার ওঠায় আমি বলে ফেলেছিলাম, আচ্ছা লিখব তোমার চ্যানেলের জন্য। সবার সামনে এমনটা বলে ফেলেছি বলেই লিখতে হল শেষমেশ। তা সেই লেখা কী ছাপা, কী অডিও স্টোরি, দু'ভাবেই সমাদৃত হয়েছে। তাই হয়তো তারানাথকে নিয়ে আরও লিখব।''
স্বাধীনতার ঠিক অব্যবহিত আগের এক কলকাতায় তারানাথের বাস হলেও তার কাহিনিগুলির সময়কাল কিন্তু আরও আগের। যে সময়টা মুছে গিয়েছে কবে। কিন্তু বাংলার জলহাওয়ায় আজও মিশে রয়েছে সেই হারানো দিনকাল। তারানাথ-কাহিনির হৃদস্পন্দনে অতীতের 'লাবডুব' শুনতেই কান পেতে রেখেছে বাঙালি পাঠক। সেকথা মাথায় রেখেই তারানাথের অফুরান কাহিনিস্রোতে কলম ডুবিয়েছেন তথাগত।
ফেলে আসা সময়
কিন্তু কেন তারানাথ? তন্ত্রসাধনা বা অতিলৌকিকতার রহস্যঘন আবহই কি এর আসল ইউএসপি? তারাদাস-পুত্র একমত নন। তাঁর মতে, ''অলৌকিকতা তো পাঠককে টানেই। কিন্তু এই কাহিনিতে ফেলে আসা একটা যুগকে দেখতে পাওয়াই আসলে সব থেকে বড় আকর্ষণ। দেখবেন অনেকেই তারানাথকে নিয়ে লিখেছেন। নেট দুনিয়া ছেয়ে গিয়েছে বহু তারানাথে। কিন্তু সেসব লেখা কি জমেছে? আসল জায়গাটা না বুঝে লেখার কারণেই হয়তো এটা হয়েছে। পড়লেই বোঝা যায় পড়াশোনা না করেই লেখা।'' তন্ত্রসাধনা নিয়ে কৌতূহল ছিলই। কিন্তু কলম ধরবেন বলেই তথাগত আলাদা করে সেই নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। যে কাহিনি লিখেছেন, সেখানে কাল্পনিক মন্ত্র যেমন ব্যবহার করেছেন, তেমনই বই থেকেও নিয়েছেন। শুধুই তন্ত্র নিয়ে পড়াশোনা নয়, সেই হারানো সময়ের কলকাতা ও সমগ্র বাংলা নিয়েও পড়তে হচ্ছে। এই মুহূর্তে আরও কাহিনি নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে। আশ্বস্ত করছেন, মাস দুয়েকের মধ্যেই হয়তো পরের আখ্যান উপহার দিতে পারবেন। ''বলা হয়েছিল পয়লা বৈশাখের মধ্যে যদি হয়। তা পারিনি। তবে খুব বেশি দেরি করব না এটা বলতে পারি।''
বিভূতিভূষণের তারানাথ কিছুটা যেন রুক্ষ। পরিবর্তে তারাদাস চরিত্রটিকে যেন কিছুটা নরম করে গড়েছিলেন। কিন্তু তথাগত কতটা বদলাবেন তারানাথ জ্যোতির্বিনোদকে? সে বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি জানাচ্ছেন, ''আমার তারানাথ তো একটু আলাদা হবেই। হয়তো আমরা একই বংশের, কিন্তু মানুষ হিসেবে প্রত্যেকেই আলাদা। ভিন্ন সময়ের প্রতিনিধিও। তাই অবিকল একই যে হবে না সেটাই তো স্বাভাবিক।'' কিন্তু একটা বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। চরিত্রের ডাইমেনশনে যে পরিবর্তনই হোক, হারানো সময়কালের অমলিন স্পন্দন ছাড়া তারানাথ-কাহিনি হতে পারে না। অসম্ভব।
হারানো সময়ের মায়াকাজল
মট লেনের একতলা এক বাড়ির স্যাঁতস্যাঁতে ঘরময় ঘন ছায়া, এলোমেলো হাওয়ার ভিতরে এক প্রবীণের স্মৃতিচারণ। হ্যাঁ, গল্পের মধ্যে অলৌকিকতা রয়েছে। কিন্তু সেগুলোকে ছাপিয়ে আসল হয়ে ওঠে গল্পের মজলিসি মৌতাত ও বাংলার হারানো সময়ের মায়াকাজল দিনগুলি। যা আর কখনও দেখা যাবে না, তাকে ছুঁয়ে আসতে ইচ্ছে হতে থাকে। এখানেই তারানাথের আসল সাফল্য। আধাসফল তান্ত্রিক হয়েও সে গল্পের মালা বুনে বুনে ফেলে আসা সময়কেই গেঁথে রেখে গিয়েছে।