পৌষালি কুণ্ডু: উপন্যাস-নাটকের গল্প থেকে সিনেমা তৈরির ইতিহাস দীর্ঘ। কিন্তু একবারে বলিউডের সুপারহিট, কাল্ট মুভির মঞ্চায়ন সম্ভবত বাংলার নাট্যজগতে এই প্রথম। 'আনন্দ'-এ রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন জুটির কথা মনে নেই, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ১৯৭১ সালের সেই ছবির কাহিনিকে নাটক হিসাবে মঞ্চস্থ করছেন নৈহাটি ব্রাত্যজনের কুশীলবরা। কী ভীষণ সাহসী চ্যালেঞ্জ এঁরা নিয়েছেন। ভাবছেন তো?

বেশিরভাগ সময়েই রিমেক চাপা পড়ে যায় আসলের গৌরবের চাপে। কিন্তু এখানে সসম্মানে পাস করে গিয়েছে নাটক 'আনন্দ' টিম। অভিনয়, চিত্রনাট্য, গান নির্মাণ, মঞ্চ পরিকল্পনা বেশ 'হটকে'। এই নাটকে উত্তর কলকাতার কমার্শিয়াল থিয়েটারের বিনোদনের সঙ্গে গ্রুপ থিয়েটারের সামাজিক বার্তা, নতুন থিমের অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন তরুণ নির্দেশক অরিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশাপাশি হিন্দি সিনেমার গান, হেমন্ত-নচিকেতা-সুমনের গানের সঙ্গে ব্রিটিশ অপেরা স্টাইলে সংগীতের ব্যবহার নাট্যজগতে এক নতুন ঘরানা সৃষ্টি করল। মূল গল্প এক রেখে পদ্মনাভ দাশগুপ্তর নাট্যরূপ-ডায়ালগ বর্তমান সময়কে তুলে ধরেছে। তবে এই নাটকের অমূল্য প্রাপ্তি 'আনন্দ'রূপী ভাস্কর মুখোপাধ্যায় এবং ডা. ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্রে বারাকপুরের তৃণমূল সাংসদ পার্থ ভৌমিকের তুখড় অভিনয়। সিনেমায় এই দুই চরিত্রে দেখা গিয়েছিল রাজেশ খান্না আর অমিতাভকে। দুই সুপারস্টারের ম্যানারিজমকে দূরে সরিয়ে রেখে, তাঁদের অনুকরণের দিকে পা না বাড়িয়ে চরিত্র দু'টি স্বতন্ত্রভাবে বুনেছেন ভাস্কর ও পার্থ। চাপা স্বভাবের ডাক্তারের চরিত্রে পার্থবাবুর অভিনয় মনে থাকবে। বন্ধুর মৃত্যু নিশ্চিত বুঝতে পেরে তাঁর হৃদয়ের অন্তস্তলে রক্তক্ষরণের দৃশ্যগুলিতে অনুচ্চারিত বহু কথা যে অভিব্যক্তির মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন তা সিনিয়র বচ্চনকেও চ্যালেঞ্জ ছুড়বে, 'শিওর'।
এর আগে উৎপল দত্তর নাটক 'ফেরারী ফৌজ'-এর পুনর্নির্মাণ করেছে নৈহাটি নাট্যসম্বন্বয়। তার থেকেও কঠিন ছিল নৈহাটি ব্রাত্যজন ও নৈহাটি নাট্যসমন্বয় প্রযোজিত বাংলার কালজয়ী সিনেমা 'দাদার কীর্তি', 'বসন্ত বিলাপ'-এর মঞ্চায়ন। কিন্তু সিনেমা থেকে নাটকে রূপান্তরের কঠিনতম প্রোজেক্ট নিঃসন্দেহে 'আনন্দ'-এর নাট্য রিমেক। সব ক'টি নাটকেই নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন সাংসদ-অভিনেতা। আড়াই ঘণ্টার এই নাটকের মজবুত মেরুদণ্ড ভাস্কর মুখোপাধ্যায়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কী-ই না করলেন নাট্যজগতের এই তরুণ তুর্কি। টুপি পরে ঘাড় হেলিয়ে রাজেশ খান্নার মতো 'বাবুমশাই' ডায়লগ থ্রোয়িং ইচ্ছাকৃতভাবেই কপি করেছেন, আবার পর মুহূর্তে নিজস্ব ছন্দে অভিনয় করে, গান গেয়ে দর্শককে কাঁদিয়ে, হাসিয়ে মন জিতে নিয়েছেন। ভাস্করের ক্যাজুয়াল অভিনয় দেখে কখনও মনে হয়েছে পাশের বাড়ির ছেলে, কখনও পাড়ার ছটফটে-উৎসাহী বন্ধু। কখনও যেন 'কাল হো না হো'-র শাহরুখ খান!
পদ্মনাভর ডায়লগ নির্মাণ নাটককে কখনও অতিনাটকীয় করে তোলেনি। মেট্রনের চরিত্রে নজর কেড়েছেন কস্তুরী চক্রবর্তী। ডাক্তারের প্রেমিকা লিপিকা হয়েছেন দেবযানী সিংহ। বর্তমানে বহু নাটকে তাঁর সাবলীল অভিনয় প্রশংসা কুড়িয়েছে দর্শকের। এছাড়া যথাযথ পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীময়ী রায়, অনুরণ সেনগুপ্ত-সহ অন্যান্য শিল্পীরা। মঞ্চ, আলো, সম্পাদনা, দৃশ্য পরিকল্পনায় অভিনবত্ব, স্মার্টনেসের ছোঁয়া দিয়েছেন দেবাশিস। মন্ত্রী ও স্থানীয় বিধায়ক শশী পাঁজার একান্ত উদ্যোগে সম্প্রতি নাটকটি মঞ্চস্থ হয় গিরিশ মঞ্চে।