বাঙালির পয়লা বৈশাখ মানেই নস্ট্যালজিয়া। পোশাক থেকে খাবার, আড্ডা থেকে হালখাতা, সবেতেই থাকে বাঙালিয়ানার ছাপ। তবে আজকের বাঙালি কি ততটাই উন্মুখ থাকে নববর্ষ নিয়ে? অতীতের স্মৃতিচারণা এবং আগামী নববর্ষের পরিকল্পনা নিয়ে 'সংবাদ প্রতিদিন' ডিজিটালে লিখলেন শুভঙ্কর দে।

আবার একটা নতুন বছর। আবারও একটা পয়লা বৈশাখ। এই দিনটাকে ঘিরে কত যে স্মৃতি! মনে পড়ে কলেজ স্কোয়্যারে চড়কের মেলা বসত। আমরা সব সেই মেলায় ঘুরতে যেতাম নববর্ষের আগের দিন। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে যে লক্ষ্মী-গণেশ পুজো হত, সেই বিগ্রহও ওই মেলা থেকেই কেনা হত। আর বচ্ছর পয়লায় আমাদের দপ্তরে লেখকদের হইহই! প্রকাশকের ঘর মাতিয়ে রাখতেন তাঁরা। আজও রাখেন। কিন্তু পুরনো মানুষদের কথা খুব মনে পড়ে।
একটা সময় মনে আছে, পয়লা বৈশাখে কোল্ড ড্রিঙ্কস খাওয়ানো হত অতিথিদের। সেই সময়ের একটা গল্প বাবার থেকে শোনা। তখন কলকাতায় সদ্য থামস আপ এসেছে। পয়লা বৈশাখ শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমাদের দপ্তরে এলে বাবা যেই জানতে চেয়েছেন কী খাবেন, উনি অমনি বুড়ো আঙুলের বিশেষ ভঙ্গি করলেন। আর জিজ্ঞেস করলেন, ''এটা কী জানো?'' বাবা তো কিছুই বুঝতে পারছেন না। তখন তিনিই ভেঙে বললেন, ''এটা থামস আপ। তুমি আমাকে একটা থামস আপ খাওয়াও।''
পরবর্তী সময়ে অবশ্য কোল্ড ড্রিঙ্কসের জায়গা নিল ডাব। কলেজ স্ট্রিটের যে চার মাথার মোড়, সেটা ডাব পট্টি। রাত আড়াইটে-তিনটে নাগাদ সেখানে ডাব নামতে থাকে। নানা জায়গা থেকে ডাব আসে। তারপর সেগুলো গোটা কলকাতায় ছড়িয়ে পড়ে। মনে পড়ে বাবার সঙ্গে ভোর তিনটে-সাড়ে তিনটে নাগাদ যেতাম। একহাজার ডাব নিয়ে আসা হত। সেটা পয়লা বৈশাখের দু'দিন আগে। পরদিন একজন আসতেন। তিনি ওই ডাবের মুখগুলো ছাড়িয়ে রাখতেন।
মনে পড়ছে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা। আমাদের গলিটা দিয়ে ঢুকেই ডানদিকে ডাঁই করে রাখা থাকত ডাব। উনি সোজা গিয়ে বলতেন, ''সবথেকে বড় ডাবটা বের করো দেখি।'' মনঃপুত হলে সোজা বলে দিতেন এটা কেটে পাঠিয়ে দিতে। তারপর সিঁড়ি দিয়ে উঠে ভিতরে চলে যেতেন। পরে ডাব খাওয়া হলে আঙুল ঢুকিয়ে দেখতেন ভিতরে শাঁস আছে কিনা। থাকলে সেটাও কেটে আনতে হত। বুদ্ধদেব গুহ যতবারই এসেছেন একটা না একটা গান শুনিয়েছেন। সকলে মুগ্ধ হয়ে শুনত। এমন চমৎকার গলা ছিল তাঁর! আজ আর এই মানুষরা নেই। কিন্তু পয়লা বৈশাখ আছে। তাই মনে পড়ে যায়।
কিছু কিছু জায়গায় যে এখনও নববর্ষ মহা সমারোহে উদযাপিত হয়, তার মধ্যে বইপাড়া অবশ্যই রয়েছে। আজকের লেখকরাও এই দিনটা আড্ডা-হাসিতে মাতিয়ে রাখেন। তাছাড়া এই দিন নতুন বইও প্রকাশিত হয়। আগে অবশ্য অনেক বেশি প্রকাশ পেত। এখন অবশ্য বইপ্রকাশ অনেকটাই বইমেলাকে ঘিরে। তবুও পয়লা বৈশাখেও নতুন বই বেরোয়। সব মিলিয়ে তাই আজও এই দিনটার জন্য অধীর প্রতীক্ষা থাকে আমাদের।