সব্যসাচী বাগচী
ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের মতে ভারতীয় ক্রিকেটের নবজাগরণকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম, প্রয়াত অজিত ওয়াদেকরের (Ajit Wadekar) অধিনায়কত্বে ১৯৭১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ইংল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট সিরিজ জয়। দ্বিতীয়, সবাইকে চমকে দিয়ে কপিল দেবের (Kapil Dev) নেতৃত্বে ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ (1983 World Cup) চ্যাম্পিয়ন হওয়া। ভারতীয় ক্রিকেটে একাধিক মাইলস্টোন গড়েছেন ‘কপিলস ডেভিলস’-এর স্রষ্টা। এহেন ‘হরিয়ানা হ্যারিকেন’ ৬৫ বছরে পা দিলেন।
আর তাঁর সঙ্গে অশোক মালহোত্রার (Ashok Malhotra) বন্ধুত্বের বয়স বেড়ে দাঁড়াল ৫৩ বছর। গত ৫০ বছরের বেশি সময়ের বন্ধুত্বের সম্পর্ক ওঁদের অনেক উত্থান-পতনের সাক্ষী থেকেছে। দু’জনের সম্পর্কে অনেকবার এসেছিল দুরত্ব। আবার মনের টানে দু’জন একসঙ্গে করেছেন সুখ-দুঃখের গল্প। একটা সময় অনেক বছর তো কপিলের সঙ্গে কথাই বলতেন না ভারতের প্রাক্তন ওপেনার। এহেন বাংলার প্রাক্তন অধিনায়ক ও কোচ সংবাদ প্রতিদিন.ইন-এর কাছে তাঁর ‘ক্যাপস’-এর অনেক অজানা দিক তুলে ধরলেন। লেখা ভালো এক অন্য কপিলকে চেনালেন বঙ্গ ক্রিকেটের ‘পাঁজি’।
১৯৫৯ সালের ৬ জানুয়ারি। এই দিনটায় চণ্ডীগড়ে জন্মেছিলেন প্রথম বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক। তাঁর ৬৫তম জন্মদিনে স্মৃতির ঝাঁপি উপুড় করে দিলেন অশোক মালহোত্রা। রনজি ট্রফির ধারাভাষ্য দেওয়ার ফাঁকে টেলিফোনে বললেন, “আমার স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা না করলে, যতদূর মনে পড়ে একই দিনে দু’জন স্কুলের ক্রিকেট দলের ট্রায়াল দিতে গিয়েছিলাম। সবাই সময়মতো চলে এলেও কপিল অনেক দেরিতে এসেছিল। শুধু তাই নয়। আমাদের প্রিয় কোচ প্রয়াত দেশপ্রেম আজাদের চোখকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য পাঁচিল টপকে মাঠে ঢুকেছিল ও। কিছুক্ষণ অনুশীলন করার পর একটা লেডিজ সাইকেলে চেপে পালিয়ে যায়! আমরা তো এখনও সেই দিনগুলো নিয়ে ভাবলে হেসে লুটোপুটি খাই।”
[আরও পড়ুন: অজিদের বিরুদ্ধে আগ্রাসী বোলিং, ঝুলনের কাছ থেকে কী পরামর্শ পেলেন তিতাস?]
জন্মদিনে কিছু ব্যক্তিগত কাজে দুবাইয়ে রয়েছেন কপিল। কেমন ছিল তারকা অলরাউন্ডারের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের মুহূর্ত? অশোক মলহোত্রা ফের যোগ করলেন, “সেই ট্রায়ালেই কপিলের সঙ্গে প্রথমবার দেখা হয়েছিল। আমাদের থেকে ভালো পারফর্ম করলেও, অদ্ভুত ভাবে দেশপ্রেম আজাদ স্যরের কিন্তু ওকে পছন্দ হয়নি। আমরা মোট আটজন সেই ট্রায়ালে পাশ করলেও, কপিল সেই ট্রায়ালে ফেল করে। স্বভাবতই আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতায় ও জায়গা পায়নি। এতে ভীষণ অপমানিত বোধ করেছিল কপিল। সেই অপমানের বদলা হিসেবে একদিন অনুশীলনে আমাদের স্কুল অধিনায়ককে বাউন্সার মেরে মাথা ফাটিয়ে দেয়! সেটাও আবার দেশপ্রেম আজাদ স্যরের সামনেই ঘটে। এর পর আর স্যর ওকে কোনও দল থেকে বাদ দেননি।”
গুগল তখনও অন্য গ্রহের কথা। ভারতে রঙিন টেলিভিশনের যুগই শুরু হয়নি। সেই সময় ইমরান খান, স্যর ইয়ান বোথাম, স্যর রিচার্ড হেডলিদের মতো অলরাউন্ডারদের সঙ্গে টক্কর দিতেন কপিল দেব। একইসঙ্গে চলত সুনীল গাভাসকরের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধ। বিশ্ব ক্রিকেটের মঞ্চে নিজেকে ম্যাচ উইনার অলরাউন্ডার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক। কিন্তু তিনি কি ছোটবেলা থেকেই অলরাউন্ডার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন?
কপিলের ছোটবেলার বন্ধুর প্রতিক্রিয়া, ‘স্যরের অনুশীলনে ওপেনার ব্যাটাররা নয়, কপিল সবার আগে নেটে ঢুকে যেত। শুরু থেকেই ব্যাট চালাত। প্রথমদিকে কপিলের এমন ব্যাটিং দেখে স্যর বকাঝকা দিলেও, পরে আর আটকাতেন না। স্যর বুঝে গিয়েছিলেন যে, কপিলকে ওর ন্যাচরাল ব্যাটিং করতে দিলে সেটা দলের কাজে লাগবে। ব্যাটিংয়ের পরেও ক্লান্ত হত না কপিল। শুধু শীত নয়, প্রচন্ড গরমেও ও টানা ১০-১৫ ওভার বোলিং করে যেত। অথচ পেস ও লাইন-লেন্থের তারতম্য ঘটত না। নাগাড়ে বোলিং করতে গিয়ে অনেকবার কপিলের আঙুল কেটে রক্ত ঝরতেও দেখেছি। তবুও ও থামেনি। কারণ, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দাপট দেখানোর জন্যই ওর জন্ম হয়েছিল। অদম্য জেদ আর ডেয়ার ডেভিল মানসকিতার জন্যই কপিলের নাম অলটাইম গ্রেটদের তালিকায় থেকে যাবে।”
দীর্ঘ সময়ের বন্ধুত্ব হলেও একটা সময় কপিল-অশোক সম্পর্কে চিড় ধরেছিল। মালহোত্রা অনেক বছর তাঁর বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেননি। কিন্তু কেন কপিলের প্রতি ক্ষোভ জন্মেছিল? ভারতের প্রাক্তন ওপেনার বলছিলেন, ‘১৯৮৩ বিশ্বকাপের আগে আমরা ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়েছিলাম। সেই সফরে টেস্ট দলে জায়গা না পেলেও একদিনের সিরিজে ভালো পারফর্ম করি। স্বভাবতই বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পাওয়ার আশা করেছিলাম। যদিও অধিনায়ক কপিল আমার হয়ে কথা বলেনি। এর পর বিশ্বকাপের শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আমাদের দেশে এসে সব ফরম্যাটে ভারতীয় দলকে দুরমুশ করে চলে যায়। অথচ সেই একদিনের সিরিজেও রান করেছিলাম। জামশেদপুরে একদিনের ম্যাচে ৬৫ রান করার পর কপিল আমার হাত ধরে নিজের ঘরে নিয়ে যায়। আমি রাগে ফুঁসছিলাম। ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমি কি বিশ্বকাপ খেলার যোগ্য ছিলাম না? কপিলের জবাব ছিল, ‘তোর উপর ভরসা রাখতে পরিনি।’ সেটা শোনার পর অনেক বছর ওর সঙ্গে কথা বলিনি। তবে এখন আর রাগ করে লাভ নেই। কারণ, আমরা দুজনেই এখন বুড়োদের দলে।”
যত দিন ক্রিকেট থাকবে, ভারত খেলবে, কপিল দেবের নাম শীর্ষে লেখা থাকবে। কেরিয়ারে ১৩১ টেস্টে নিয়েছেন ৪৩৪ উইকেট। রান ৫২৪৮। ওয়ান ডে ফরম্য়াটে ২২৫ ম্যাচে ২৫৩ উইকেট। রান ৩৭৮৩। প্রথম শ্রেণি এবং লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে ঝুরি ঝুরি উইকেট। আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা করে নেওয়া কপিলের ক্যাবিনেটে রয়েছে অর্জুন পুরস্কার। সঙ্গে পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, ভারত গৌরব সম্মান। পাশাপাশি সর্বকালের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডারের তকমা তো আছেই।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে বন্ধু কপিল এখনও অশোক মালহোত্রা, একে অপরের মনে এখনও আলাদা জায়গায় রয়েছেন। এবং থেকে যাবেন।