‘ছোটলোক’ ওয়েব সিরিজের দুর্দান্ত সাফল্যের পর মন খুলে স্পষ্ট কথা বললেন দামিনী বেণি বসু। মুখোমুখি বিদিশা চট্টোপাধ্যায়।
‘ছোটলোক’-এর ‘সাবিত্রী মণ্ডল’ যে আপাতদৃষ্টিতে ‘আনস্মার্ট’, ‘ক্যাবলা’ পুলিশ অফিসার– তার এই জনপ্রিয়তা, আপনার কাজের প্রশংসা, সব মিলিয়ে ঠিক কী মনে হচ্ছে?
আমার একটাই জিনিস মনে হচ্ছে, এবং বার বার মনে হচ্ছে, আমি যে আসলে অগুনতি মানুষের হয়ে একটা অদৃশ্য লড়াই লড়ছিলাম, সেটা সম্পর্কে আমি এতটা ওয়াকিবহালই ছিলাম না। এটা প্রায় আয়না দেখানোর মতো। আর এই আয়নাতে যে এত হাজার হাজার মুখ রয়েছে, যারা নিজেদের দেখতে পাচ্ছে, এটা আমার কাছে বিশ্বরূপ দর্শনের মতো। এক্সট্রিমলি হামব্লিং এক্সপিরিয়েন্স। যখন পার্টটা তৈরি করছিলাম, সেটা ছিল লোনলি প্রসেস, কবিকে ইনক্লুড করেই বলছি। এখন সেই আয়নাতে অনেক মানুষ নিজেদের দেখতে পাচ্ছে, সেটাই আমার আরাম। আমি রাতে ভালো করে ঘুমোতে পারছি।
সাধারণ দর্শক খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে রিঅ্যাক্ট করেছে…
আমরা একটা কথা শুনি, পাওয়ার অফ দ্য কমন ম্যান। সেই সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া আমরা পেয়েই চলেছি। এখানে ইন্ডাস্ট্রির জোর বা আমার যারা ইন্ডাস্ট্রির সহকর্মী, তারা সোচ্চারে বলছে, তেমন তো নয়। অভিমান থেকেই বলছি, পাওয়ার জায়গা থেকে আমি কোনও আশাই রাখি না। ন্যাংটার নেই বাটপাড়ের ভয়। আমার হারানোর কিছু নেই। ইন্ডাস্ট্রির কলিগদের সাপোর্ট পেলে হয়তো ভালো লাগত। কিন্তু তাদের ‘ওপেন সাপোর্টটা’ যখন পাচ্ছি না, ঠিক আছে। কয়েকজন ব্যতিক্রম ছাড়া, সবাই ফোনে বা মেসেজে আলাদাভাবে সাপোর্ট করছে। ওপেনলি সেলিব্রেট করছে না। তার নিশ্চয়ই কারণ আছে, সেটা আমি জাজ করার জায়গায় নেই। কিন্তু ‘সাবিত্রী মণ্ডল’ আর আমার হাতে নেই। এটা আমার দারুণ লাগছে। সাধারণ মানুষ তাকে নিয়ে নিয়েছে। ‘ছোটলোক’-এ খুব বড় বড় ডায়লগবাজি নেই, বন্দুক উঁচিয়ে অ্যাকশন নেই, কিন্তু তাতেও দর্শক এমপাওয়ার্ড ফিল করছে।
জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশন আমরা দেখেছি ‘ছোটলোক’-এ। আপনার এই সাফল্যের পর পুরুষ কলিগদের হিংসা করতে দেখেছেন, বা এতদিন কাজের অভিজ্ঞতা কী বলে?
এই প্রশ্নটা যে এখনও মহিলা অভিনেতাকে করতে হচ্ছে, তাতেই উত্তর রয়েছে। এটা অনির্বাণ ভট্টাচার্য, দেব বা জিৎ-কে করতে হত কি? কিন্তু আমাদের করা যায়। আর করা যায় মানেই, নিশ্চয়ই তোমার মনে হয়েছে, এবং তুমিও হয়তো তোমার কর্মক্ষেত্রে সেটা ফেস করেছ। কর্মক্ষেত্র আলাদা হলেও, সমস্যা সব ক্ষেত্রেই। আমার মনে হয়, শুধু দাদা-ভাই-কাকা-জ্যাঠাদের সমঝে, বুঝে পা ফেলা তা নয়। আরও ভয়ংকর হচ্ছে ইট ইজ অলসো অ্যাবাউট ওয়াকিং অন এগশেলস অ্যারাউন্ড উইমেন সো দ্যাট দে ডোন্ট ফিল ইনসিকিওর, অ্যাবাউট ইউ বিইং অ্যারাউন্ড মেন।
এটা অনেকটা ‘বার্বি’ ছবিতে ‘গ্লোরিয়া’-র সেই মোনোলগের মতো শোনাল, যেখানে বেশি সফল, বেশি সুন্দর হতে বারণ করেছে তির্যক সুরে!
হ্যাঁ, আসলে তোমরা মহিলারা কিছুই হয়ো না। আমাদের হ্যাশট্যাগ ইন্টারনালি গ্রেটফুল থাকতে হবে, ভাবটা এমন। পিতৃতন্ত্রের মনোভাব হল, তোমরা যে বেঁচে আছ, তোমাদের যে আমরা সুযোগ দিচ্ছি, এই যে আজকে তোমরা করে খাচ্ছ, ইউ শুড বি গ্রেটফুল ফর অল অফ দিজ।
[আরও পড়ুন: ড্রাগ মাফিয়া, অসহায় বাবা, আর বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কথা বলে জিত-জীতুর ‘মানুষ’]
ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরি যখন ওয়েব সিরিজের লিড চরিত্রের জন্য আপনাকে অ্যাপ্রোচ করেন, কী প্রতিক্রিয়া ছিল?
কবি যখন আমাকে ফোন করে বলে, ‘তুই এটা করবি, আমি কিন্তু তোর কথা ভেবেই লিখছি।’ আমি তখন সন্দেহ প্রকাশ করেছিলাম, যে চ্যানেল নেবে কি না! সেটার ইতিবাচক উত্তর শুনে আমি পাঁচ সেকেন্ড থম মেরে গিয়েছিলাম। তারপর বলেছিলাম, আগে থেকে বলে দিলে, আমি যেভাবেই হোক ম্যানেজ করে নেব। আসলে কী জানো তো (কিছুক্ষণ চুপ থেকে) … এই কথাটা শুনতে আমি অভ্যস্ত নই। আমাকে অনেকেই বলেছে, ‘বাবু তোর জন্য লিখতে হবে’, ‘তোকে কী যে সে পার্ট দেওয়া যায়’… পরোক্ষভাবে আমায় বলা হয়েছে আমাকে সাদামাটা দেখতে, তাই প্রান্তিক মানুষের পার্ট দেওয়া হয়েছে। দরিদ্র বাড়িতে মায়ের চরিত্র, পরিচারিকা, বস্তিতে থাকা মাইনরিটি– এটা একটা ধরন। অন্য যেটা প্রায়ই শুনি, সেটা হল আমাকে একটু বেশি বুদ্ধিমান দেখতে। তখন সাইকিয়াট্রিস্ট, কাউন্সেলর, ইনটেলেকচুয়াল বন্ধু– এটাই মোটামুটি আমার স্পেকট্রাম। তাই নিজেকে বলেছি, সত্যেরে লও সহজে। সবটাই লুক বেসড। সবচেয়ে বড় স্টিরিওটাইপ হল পেট্রিয়ার্কি। এটার আশপাশেই সবটা ঘোরাঘুরি করবে। ‘ছোটলোক’ অনেক স্টিরিওটাইপ ভেঙেছে। আর যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখছে, বেণি কেন পার্ট পায় না, তারা আমাকে প্রশ্নটা করছে না! আমার মনে হয়, দে আর পিপল হু আর স্ট্রাগলিং দ্য মোস্ট টু বি সিন।
পরিচালক ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরির সঙ্গে ‘সাবিত্রী মণ্ডল’-এর চরিত্রটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল। তর্কের অবসান ঘটিয়ে ‘সাবিত্রী’ হয়ে উঠলেন কীভাবে?
কবির কাছে আমার মূল অভিযোগ ছিল, তুমি চরিত্রটা লিখলেও, তাকে কোনওদিন দেখোনি। কবির ধৈর্য অসীম। ও বুঝতে পেরেছিল আমার কোথায় সমস্যা হচ্ছে। আমি আসলে সাবিত্রীকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। সাবিত্রী প্রায় গিরগিটির মতো রং বদলায়। যেখানে যেমন, সেখানে তেমন। এটা আমি আমার মাকে সারাজীবন করতে দেখেছি। আমাদের শাসন করছে, বাবাকে সামলে রাখছে, দল ম্যানেজ করছে, আবার নিজের মায়ের কাছে গিয়ে একটু জুজু হয়ে যাচ্ছে। সাবিত্রীও তাই। কবি আমাকে বলেছিল, ইউ হ্যাভ টু ট্রাস্ট দ্য স্ক্রিপ্ট। আরেকটা কথা বলেছিল, ‘সাবিত্রীকে কেউ কোনওদিন বলেনি যে সে ইন্টেলিজেন্ট’। কথাটা ভিতরে গিয়ে লেগেছিল। এটা তো সারা পৃথিবীর মেয়ের কথা। হিলারি ক্লিনটনকেও পারলে তার জায়গা থেকে টেনে নামিয়ে ফেলবে, অপ্রা উইনফ্রেকেও পারলে টেনে নামাবে। দিস মেড এক্সট্রিম সেন্স টু মি।
তারপর আর সমস্যা হয়নি…
আমার হয়নি কিন্তু অনেক দর্শকের অসুবিধে হয়েছে। যারা বেণিকে চেনে, তারা সাবিত্রীকে দেখতেই পাচ্ছিল না প্রথম দু-তিনটে এপিসোডে! উলটে আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই। বুদ্ধিমান মানুষদের কি বিশেষ ধরনের দেখতে হতেই হবে? সাবিত্রী জানে না যে সে বুদ্ধিমান। তাই এখানে আমার বুদ্ধিমান, সুন্দরী, সেক্সি হওয়ার কোনও দায় নেই। আমি দুটো বাচ্চার মা, পেটের তলার দিকটা ভারী, খেতে ভালোবাসি, ছড়িয়ে লাট করি। কাউকে কিছু বোঝানোর দায় নেই। সেই দায় চিত্রনাট্য এবং পরিচালকের। সো আই স্টপড মাইসেলফ ফ্রম গেটিং ইন দ্য ওয়ে অফ দ্য স্ক্রিপ্ট। আসলে বুদ্ধিমান মহিলাদের কেমন দেখতে হয় এটা এতদিন আমরা পুরুষের চোখ দিয়ে দেখে এসেছি মেনস্ট্রিম মিডিয়াতে। ইট অলওয়েজ হ্যাজ বিন রিটেন ফ্রম এ মেল গেজ হাউ অ্যান ইন্টেলিজেন্ট উওম্যান শুড বি। এই চরিত্রের জন্য আমাকে বুদ্ধিমান দেখতে লাগার দায় থেকে পরিচালক ছুটি দিয়ে দিয়েছিল।
তারপর…
গত বছর শুটিংয়ের এক মাস আগে দিদার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। অসুস্থতায় একবারে শুকিয়ে ছোট্ট, এতটুকু হয়ে গিয়েছিলেন। আমি দিদার খুব ন্যাওটা ছিলাম। এতদিন পরে দেখতে পেয়ে একেবারে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। দিদা খুব স্ট্রং মহিলা ছিলেন, সাংঘাতিক স্ট্যামিনা, জেদি, এদিকে ছোটখাটো চেহারা। সেদিন মনে হল, অন্য সমাজে বড় হলে দিদা স্কুলের হেড মিসট্রেসও হতে পারতেন। এবং আমার দিদাকেও কেউ বলেনি
তুমি বুদ্ধিমান, যে তুমি কিছু করতে পারো। দিদা পিঠটা হালকা কুঁজো করে হাঁটত, চোখ পিটপিট করত– আমার মনে হল যে এটাই। আমি এটাই করব। আসলে ‘সাবিত্রী মণ্ডল’ আমার ভিতরেই ছিল, আমিই দেখতে চাইনি। আমাকে এটা গ্রহণ করতে হয়েছে যে দেয়ার ইজ এ পার্ট অফ মি যাকে কোনওদিন সেভাবে অ্যাকনোলেজ করা হয়নি। তারপর আর সাবিত্রী হয়ে উঠতে কোনও বাধা পাইনি।