বোরিয়া মজুমদার: প্রজ্ঞানন্দর সঙ্গে বৃহস্পতিবার যখন কথা হল, ভারতীয় সময়ে মাঝরাত পেরিয়ে গিয়েছে, রাত একটা বাজে। এখানে বলে রাখি, আমার বন্ধু মারিয়া এমিলিয়ানোভার সাহায্য ছাড়া এটা হত না। ফাইনালের পর প্রজ্ঞানন্দের সাক্ষাৎকারের জন্য অনেক আগে থেকে চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু দাবা বিশ্বকাপ ফাইনাল হেরে যাওয়ার পর মঞ্চ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন দেশের বিস্ময় দাবাড়ু। পরে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের সময় ফিরে এসেছিলেন এবং সব মিটিয়ে রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দ একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন ‘সংবাদ প্রতিদিন’-কে।
প্রশ্ন: প্রথমেই বলি, কীর্তির জন্য আপনাকে অভিনন্দন। বিশ্ব দাবা ফাইনালে রানার্স আপ হলেন। অনুভূতি কেমন?
প্রজ্ঞা: যে ভাবে গোটা টুর্নামেন্ট খেলেছি, তাতে আমি তৃপ্ত। ফাইনালে আরও ভাল খেলতে পারতাম। কিন্তু সব মিলিয়ে ভালই পারফর্ম করেছি আমার মতে। টানা পাঁচ সপ্তাহ দাবা খেলে গিয়েছি আমি। ক্লান্ত লাগছে, ভেতরে ভেতরে নিঃশেষ লাগছে। শুধু আমার জন্য নয়, বাদবাকিদের জন্যও। আর আমার কাছে আরও বেশি কারণ, এই প্রথম আমি দাবা বিশ্বকাপের ফাইনাল খেললাম। কিন্তু সব মিলিয়ে যে ভাবে খেলেছি, তাতে আমি আমি খুশি।
প্রশ্ন: দাবা বিশ্বকাপ ফাইনালে ওঠা আপনার কেরিয়ারের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
প্রজ্ঞা: বিশাল মুহূর্ত বলতে পারেন। আমি তো এ রকম একটা ব্রেক থ্রু-র জন্যই অপেক্ষা করে ছিলাম। তবে বিশ্বাস করুন, আমি ভাবিনি যে দাবা বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠব। দাবা বিশ্বকাপ বিরাট টুর্নামেন্ট। সেখানে ফাইনালে উঠেছি আমি। নিঃসন্দেহে আগামী টুর্নামেন্টগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস পেয়ে গেলাম।
প্রশ্ন: আপনার ফাইনাল ম্যাচ ভারতে বহু দর্শক দেখেছেন। দাবা নিয়ে এত আগ্রহ সচরাচর দেখা যায়নি কখনও ভারতে। এতে বোঝা যায়, খেলাটার উন্নতি হচ্ছে। কাগজে-কাগজে ভারতের চন্দ্রযান সাফল্যের পর দ্বিতীয় শিরোনামই ছিল আপনার ফাইনাল। কী বলবেন?
প্রজ্ঞা: এটাই বলব যে, দাবা নামক খেলাটার এ জিনিস দরকার ছিল। আগামীতে যদি দাবা নিয়ে লোকের আগ্রহ বাড়ে, যদি ভবিষ্যতে লোকে দাবাকে আরও বেশি করে কেরিয়ার হিসেবে বেছে নেয়, তাতে খেলাটারই লাভ। আর তাতে ভারতীয় দাবারও লাভ। কারণ, তাতে আরও বেশি করে প্রতিভা উঠে আসবে। আরও বেশি করে লোকে খেলাটাকে ভবিষ্যতে অনুসরণ করবে, খোঁজখবর রাখবে। আখেরে উন্নতি হবে ভারতীয় দাবারই।
[আরও পড়ুন: কেমন দল গড়লেন গড়লেন সৌরভ? কাকে বাদ দিলেন মহারাজ? জানতে পড়ুন]
প্রশ্ন: ক্যান্ডিডেটস নিয়ে আপনার কী মত?
প্রজ্ঞা: আমি ক্যান্ডিডেটসের জন্য উন্মুখ হয়ে রয়েছি। কিন্তু দাবা বিশ্বকাপ খেলতে আসার সময় ভাবিনি যে, আমি সেটা হাসিল করতে পারব বলে। আর এই ইভেন্টটা খুব আনপ্রেডিক্টেবল। কখন যে কী হয়, আন্দাজ পাওয়া যায় না। তাই আমি বিশেষ ভাবিনি। তা ছাড়া নভেম্বর পর্যন্ত একের পর এক টুর্নামেন্ট খেলব। আমার সূচি ঠাসা বলতে পারেন। সেই সমস্ত টুর্নামেন্টগুলো শেষ করার পর ক্যান্ডিডেটস নিয়ে ভাবব।
প্রশ্ন: একটা কথা বলুন। দাবা বিশ্বকাপে আপনি মোটামুটি সমস্ত রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধেই জিতেছেন। নিজের খেলা নিয়ে এরপর নিশ্চয়ই আপনার ভাল লাগছে?
প্রজ্ঞা: অবশ্যই। এমনকী ফাইনালেও ম্যাগনাসের (কার্লসেন) বিরুদ্ধে প্রথম টাইব্রেকে সুবিধেজনক অবস্থায় ছিলাম আমি। কিন্তু তার পর খেই হারিয়ে ফেলি। র্যাপিড গেমে এ সব হয়। কিন্তু পিছনে ফিরে তাকালে মনে হচ্ছে, এই অভিজ্ঞতা আমাকে প্রচুর আত্মবিশ্বাস দেবে। বিশ্বের সেরা প্লেয়ারদের হারানো আমার কাছে স্মরণীয় কৃতিত্ব তো বটেই।
প্রশ্ন: আপনার কি কোথাও গিয়ে মনে হচ্ছে যে, স্নায়ুর চাপে ভুগেই ফাইনালটা হারতে হল? কিংবা অভিজ্ঞতায় কোথাও গিয়ে মার খেতে হল? কারণ, এটা সবাই জানে যে বিশ্বকাপ ফাইনালের চাপ সামলানো সহজ নয়।
প্রজ্ঞা: না। আমি তো বলব, গোটা বিশ্বকাপ জুড়ে স্নায়ুর চাপ দারুণ সামলেছি আমি। বিশেষ করে অর্জুনের বিরুদ্ধে ম্যাচটায়। গোটা ম্যাচ জুড়ে আমি শান্ত ছিলাম। বলতে পারেন, অভিজ্ঞতায় কিছুটা মার খেয়েছি। কিন্তু সব মিলিয়ে দেখলে আমি নিজের নার্ভ ভাল সামলেছি। ক্রমাগত চাপ সামলে ফাইনালে ওঠা, আমার কাছে বড় প্রাপ্তি।
[আরও পড়ুন: কীভাবে ফের সর্বোচ্চ স্কোরার হতে পারেন রোহিত? টিপস দিলেন বীরু]
প্রশ্ন: অনেকেই বলছেন যে, আপনি বিশ্বনাথন আনন্দের যোগ্য উত্তরসুরি।
প্রজ্ঞা: (হাসি) আনন্দ স্যর অনেক কিছু অর্জন করেছেন জীবনে। সুবিশাল কীর্তি ওঁর। আনন্দ স্যরের সঙ্গে তুলনার জায়গায় পৌঁছতে গেলে অনেক, অনেক দূর যেতে হবে আমাকে। আমাকে ধারাবাহিক হতে হবে, নিজের খেলার উন্নতি করতে হবে। আর আমি যে একা ভাল করছি, তা তো নয়। আরও অনেকে ভাল খেলছে। গুকেশ, অর্জুন, নিহাল প্রত্যেকে ভাল খেলছে। ভারতীয় দাবার ভবিষ্যতকে সুরক্ষিতই দেখাচ্ছে। কিন্তু আবারও বলছি, আনন্দ স্যরের সঙ্গে তুলনার জায়গায় পৌঁছতে গেলে অনেক কিছু অর্জন করতে হবে আমাকে।
প্রশ্ন: কিন্তু এই যে আপনি আনন্দকে আদর্শ করে এগোচ্ছেন, ওঁর মতো লক্ষ্যমাত্রা সেট করছেন, আপনাকে ভবিষ্যতে ভারতীয় দাবার সম্ভাব্য রোলমডেল হিসেবে ধরা হচ্ছে, এ সমস্ত কি আপনাকে কোথাও গিয়ে তাতায় না? আপনার কীর্তি তো ভারতীয় দাবাড়ুদের পারফরম্যান্স-মানদণ্ড আরও উঁচুতে নিয়ে গেল।
প্রজ্ঞা: তাতায়। আনন্দ স্যরের কেরিয়ার পথ অনুসরণ করা বিশাল এক মোটিভেশন। কিন্তু ওই যে বললাম, আনন্দ স্যরের জায়গায় যেতে হলে প্রচুর খাটাখাটনি করতে হবে আমাকে।