কে বলেছে, একদম ক্যালোরি মেপে খেলে তবেই আপনি ফিট থাকবেন? বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাপা নয়, বরং একটু বেশি ক্যালোরি খেলে বেশি সুস্থ থাকা যায়। ক্যালোরির অনুপাত নিয়ে কেন এমন অভিমত? ব্যাখ্যা করলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. প্রশান্ত বিশ্বাস।
একটি গবেষণার তথ্য দিয়েই শুরু করা যাক। সম্প্রতি কানাডার টরন্টো ইউনিভার্সিটির গবেষকদের দাবি, আমন্ড বাদামে যা ক্যালোরি উপস্থিত থাকে, শরীরে তার পুরোটা দ্রবীভূত হয় না। মূলত যে কোনও বাদামের ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা একই। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, যদি কেউ সারাদিনের প্রয়োজনীয় ডায়েটের কিছুটা অংশ আমন্ড বাদাম থেকে নেন, সেক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে যতটা ক্যালোরি ভেবে খাওয়া হচ্ছে তার প্রায় ২০-২৫ শতাংশ ক্যালোরি শরীরে দ্রবীভূত হচ্ছে না।
এই সূত্র ধরেই গবেষকরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, যাঁরা নিত্য ডায়েট করেন, ক্যালোরি মেপে খান তাঁরাও কিন্তু আসলে ক্যালোরির অভাবের মধ্য দিয়েই যান। কীভাবে? কারণ যে খাবারই খান না কেন, বাদাম কিংবা বাদাম ছাড়া অন্যান্য লো ক্যালোরি ফুড তা সবই কিন্তু পুরোপুরি শরীরে শোষিত হয় না। তাই নিয়ন্ত্রিত ক্যালোরিও শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণে পায় না। এতে করে ভালো করতে গিয়ে শরীর খারাপ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি।
ক্যালোরি ডেফিসিয়েন্সি
খাবার বলতে তার মধ্যে থাকে, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ফ্যাট। আর হচ্ছে বিভিন্ন মিনারেলস যেমন ভিটামিন ইত্যাদি। তবে মূল তিনটি উপাদানের মধ্যে ১ গ্রাম ফ্যাট থেকে ৯ কিলো ক্যালোরি শক্তি বা এনার্জি আমরা পাই। প্রতি গ্রাম কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিনের ক্ষেত্রে মেলে ৪.২ কিলোক্যালোরি শক্তি। তবে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে, ফ্যাটযুক্ত খাবার আমরা কম খেতে বলি। এতে করে দেখা যাচ্ছে শরীরের পুষ্টির জন্য যেটুকু দরকার সেটাও অভাব থেকে যাচ্ছে। ফলে আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিডের অভাব দেখা দেয়।
ফ্যাটের প্রয়োজনীয়তা কিন্তু রয়েছে, বিশেষত গুড ফ্যাটের প্রয়োজনীয়তা। তাই ডায়েটের চক্করে প্রয়োজনীয় ক্যালোরিও শরীরে না পৌঁছলে তা থেকে হার্টের সমস্যা ও আরও নানা অসুখের প্রকোপ পড়ে। মস্তিষ্কের ডেভলপমেন্ট, ত্বকের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে ও লিভারের কার্যকারিতা ঠিক রাখতে ফ্যাট কিন্তু দরকারও। তাই ক্যালোরি মেপে খেতে গিয়ে লো-ক্যালোরি ফুডের প্রতি বেশি ঝোঁক কিন্তু হিতে-বিপরীত করতে পারে। উপকারী ফ্যাটের অভাবে শরীর ভালো থাকার বদলে আরও খারাপ হতে শুরু করে।
তার মধ্যে যদি যা আমরা দেখে-মেপে ক্যালোরি বুঝে খাচ্ছি, সেটাও যদি পুরোটা শরীরে দ্রবীভূত না হয় সেক্ষেত্রে আরও চাপ। আপনি রোগা হচ্ছেন হয়তো। এতে মানসিক শান্তি পেলেও শরীরে কিন্তু অনেক কিছুর অভাব থেকে যেতে পারে। এসেন্সিয়াল কিছু উপাদানও আমরা পাই না যদি ক্যালোরি উপযুক্ত পরিমাণে শরীরে প্রবেশ না করে। বিশেষ করে কনজ্যুগেটেড লিনোলেনিক অ্যাসিড, যা গর্ভাবস্থায় অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। এটা সদ্যোজাতর ক্ষেত্রেও দরকার এটি। অতিরিক্ত লো ক্যালোরি ফুড খেলে এই ফ্যাটের অভাব তৈরি হয়। তাই কখনও কখনও হাই ক্যালোরি ফুডও খাওয়া প্রয়োজন।
[আরও পড়ুন: মাত্র ১৯ বছর বয়সে প্রয়াত আমির খানের ‘দঙ্গল’ খ্যাত অভিনেত্রী সুহানি]
মেপে খেলেও বুঝে খেতে হবে
প্রথমেই যে গবেষণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাট জাতীয় খাবার খেলে তার পুরোটাই যে শরীরে শোষিত হবে তা কিন্তু নয়। কিছুটা ক্যালোরি শরীরে যায়, কিছুটা মলের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। তাই খুব হিসাব করে খেতে হবে। ধরা যাক, একজনের সুস্থ থাকতে ২০০০ কিলো ক্যালোরি দরকার। সেক্ষেত্রে কিছুটা অংশ বা ২০০ ক্যালোরি তিনি বাদাম থেকে যদি নেন, সে ক্ষেত্রে যতটা আমন্ড বা বাদাম সাধারণত ২০০ ক্যালোরির হিসেবে ধরা হয়, তার চেয়ে বেশি পরিমাণ আমন্ড বা বাদাম খাওয়া উচিত। তবেই সঠিক ক্যালোরি শরীরে প্রবেশ করবে।
এ ক্ষেত্রে যদি একদম মেপে খাওয়া হয় তাহলে তার চেয়ে অনেকটা কম ক্যালোরি শরীর পাবে। যেটা মোট প্রয়োজনীয় ক্যালোরির ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। ধীরে ধীরে অভাব দেখা দেয়। যার প্রভাব পড়ে গাট ব্যাকটিরিয়ার উপড়েও। শরীরের পর্যাপ্ত ক্যালোরির কিছুটা অংশ এই ব্যাকটিরিয়ার বেঁচে থাকার জন্যও প্রয়োজন। কিন্তু পর্যাপ্ত ক্যালোরির অভাব দেখা দিলে সেক্ষেত্রে এই ব্যাকটিরিয়াগুলোও বাঁচতে পারে না। নানা সমস্যা শুরু হয়।
আর একটা কথা, এই অনুপাত কিন্তু শুধুমাত্র ফ্যাট বা বাদামজাতীয় খাবারের জন্যই প্রযোজ্য তা নয়। কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিনের ক্ষেত্রেও ক্যালোরি সম্পূর্ণ পরিমাণ খাবার থেকে শরীরে শোষিত হবে কিনা তা কীভাবে রান্না করে খাওয়া হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে। তাই পুরোপুরি মেপে না খেয়ে একটু বেশি খাওয়াতেই সম্মতি দিয়েছেন গবেষকরা।
ক্যালোরি মেপে ডায়েট করতে গেলে কিছু জিনিস মাথায় রাখুন। কোনও জিনিস যখন খাচ্ছেন, তখন পুরো ক্যালোরি মেপে না খেয়ে তার ১০ শতাংশ বেশি খান। তাহলে সেই মোট ক্যালোরির ১০ শতাংশ শরীরে শোষিত হতে না পরলেও সেটা শরীরে যাবে তাতে করে অভাব থাকবে না। একটু বেশি ক্যালোরি খেলে বরং আরও শরীর ভালো থাকবে। সঙ্গে নিত্য এক্সারসাইজ করুন ও মন ভালো রাখুন।