চন্দ্রমল্লিকা একটি অতি পরিচিত ফুল। শীতের মরশুমের ফুলের মধ্যে চন্দ্রমল্লিকা বেশ জনপ্রিয়। একে ‘শরৎ রানি’ নামেও অভিহিত করা হয়। বর্তমানে এই ফুলের চাহিদা বাড়ার কারণে বাণিজ্যিকভাবে চাষ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে চন্দ্রমল্লিকার চাষ মূলত পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব মেদিনীপুর, নদিয়া ও উত্তর ২৪ পরগনা হয়ে থাকলেও রাজ্যের অন্যান্য জেলাতেও এর ব্যাপকভাবে চাষের সম্ভাবনা রয়েছে। চন্দ্রমল্লিকার চাষ সাধারণত সেপ্টেম্বরের শেষ এবং অক্টোবরের শুরুতে হলেও শীতকালীন মরশুমই এর ফুল ফোটার প্রকৃত সময়। এই ফুলের রোগ দমনই সাফল্যের চাবিকাঠি। লিখেছেন বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের গবেষক অনিন্দিতা পাটোয়ারী।
শীতের মরশুমে চন্দ্রমল্লিকার রূপের বাহার মুগ্ধ করে সকলকে। কিন্তু এই ফুল ফোটাতে কৃষককে যত্ন নিতে হবে। রোগ প্রতিকার করতে হবে। চন্দ্রমল্লিকার বিভিন্ন রোগ এবং তার প্রতিকারের উপায়গুলি দেখে নেওয়া যাক।
পাতা ধসা বা পাতা পচা রোগ: এটি একটি ছত্রাক ঘটিত রোগ যা Septoria sp. নামক ছত্রাকের জন্য হয়। বাড়ন্ত গাছের নিচের দিকের পুরনো পাতায় প্রথমে এই রোগের লক্ষণ দেখা যায়। পাতার কিনারা থেকে ছোট ছোট গোলাকৃতির বাদামি দাগ শুরু হয় যা পরবর্তিতে বৃদ্ধি পায় এবং বাদামি রঙ পরিবর্তিত হয়ে কালো রঙের দাগে পরিণত হয়। পাতার নীচের ভাগের অংশে খয়েরি-লাল-বাদামি দাগ দেখা যায়। অসময়ে বৃষ্টিপাত হলে এই রোগের সংক্রমণ বেশি হয়। অনুকূল আবহাওয়ায় রোগের প্রাদূর্ভাব বেশি হলে গাছের পাতা শুকিয়ে যায় এবং পাতাগুলি পচে গিয়ে গাছগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে। ফুল ফোটার সময় এই ছত্রাকের আক্রমণ হলে ফুলের কুঁড়ির বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং পচে যায়।
এই রোগের প্রতিকার
ক) গাছে নিয়মিত নজরদারি করুন। আক্রান্ত পাতাগুলি পরিষ্কার করে এবং আক্রান্ত গাছকে উপড়ে ফেলে নিরাপদ জায়গায় ফেলুন।
খ) গাছের পাতায় জল না দিয়ে গোড়ায় জল দেওয়া উচিত। যাতে গাছের পাতা শুকনো থাকে এবং গাছের গোড়ায় জল না জমে।
গ) রোগমুক্ত চারা নার্সারি থেকে সংগ্রহ করুন।
ঘ) রোগের লক্ষণ বেশি মাত্রায় বেড়ে গেলে পর্যায়ক্রমে ১০-১২ দিন অন্তর যেকোনও একটি ছত্রাকনাশক স্প্রে করুন। কপার অক্সি ক্লোরাইডের গ্রুপের ওষুধ যেমন ব্লাইটক্স (৪ গ্রাম) বা ম্যানকোজেব গ্রুপের ওষুধ যেমন ইন্দোফিল এম ৪৫ (২.৫ গ্রাম) এর সঙ্গে কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ওষুধ ব্যাভিস্টিন ( গ্রাম) অথবা ডাইফেনোকোনাজোল গ্রুপের ওষুধ যেমন স্কোর (১ মিলি) বা অ্যাজোক্সিস্ট্রোবিন, গ্রুপের ওষুধ অ্যামিস্টার (১ মিলি) প্রতি লিটার জলের সঙ্গে মিশিয়ে ১২-১৫ দিন অন্তর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
ঙ) রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করুন।
পাউডারি মিলডিউ: এটিও একটি ছত্রাকঘটিত রোগ যা Erysiphe chrysanthemi নামক ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে। অক্টোবর মাসের পর আবহাওয়ার আর্দ্রতা বেড়ে গেলে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়। গাছের পুরোনো পাতাতে এই রোগের আক্রমণ বেশি পরিমাণে লক্ষ্য করা যায়।এই রোগে গাছের পাতা ধূসর হয়ে যায়। ছত্রাক বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পাতার উপরিভাগে এক সাদা রঙের আস্তরণ পড়ে যায়। অনুকূল আবহাওয়ায় রোগাক্রান্ত গাছের পাতা হলুদ বর্ণ ধারণ করে এবং কুঁচকে যায়। ফলস্বরূপ গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং ফুল উৎপাদনও হ্রাস পায়।
এই রোগ থেকে প্রতিকারের জন্য কয়েকটি সুপারিশ :
ক) গাছে নিয়মিত নজরদারি করুন। আক্রান্ত গাছগুলি উপড়ে ফেলে নিরাপদ জায়গায় ফেলুন।
খ) বাগিচায় ঘন করে গাছ বসানো যাবে না। নির্দিষ্ট দূরত্ব মেনে গাছ লাগাতে হবে যাতে গাছের মধ্যবর্তী অংশে বায়ু এবং সূর্যালোকের প্রাপ্তি ভাল হয়।
গ) নিয়মিত বাগিচা পরিষ্কার রাখতে হবে।
ঘ) রোগের লক্ষণ বেশিমাত্রায় দেখা গেলে পর্যায়ক্রমে ১৫ দিন অন্তর উল্লেখিত যে কোনও একটি ছত্রাকনাশক স্প্রে করুন। জলে দ্রবণীয় গন্ধকগুঁড়ো ৮০% পাউডার ২.৫ গ্রাম প্রতি লিটার জলে, মিইক্লোবুটনিল ১০% পাউডার ০.৫ গ্রাম প্রতি লিটার জলে, ট্রায়াডেমিফন ২৫% পাউডার ১.০ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করুন।
গ্রে মোল্ড: গ্রে মোল্ড হল চন্দ্রমল্লিকার মারাত্মক ও অন্যতম রোগ যা Botrytis cinerea নামক ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে। এখন প্রায় সব জায়গায় এই রোগের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। অক্টোবর মাসের পর আবহাওয়ার আর্দ্রতা বেড়ে গেলে এবং মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়। এ রোগের আক্রমণে ফুলের পাপড়ি, পাতা এমনকী কাণ্ডেও বাদামি জলে ভেজা দাগ দেখা যায়। আক্রান্ত গাছে ধূসর থেকে বাদামি পাউডারের মত আস্তরণ পড়ে। ফুলের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে বাদামি দাগ হয় তার সঙ্গে এই রোগের পার্থক্য হলো বয়স হলে ফুলের কিনারার প্রান্ত থেকে বাদামি দাগ শুরু হয় যেখানে গ্রে মোল্ড রোগ হলে ফুলের পাপড়ির মাঝের অংশের থেকেই বাদামি দাগ (ছিটেফোঁটা/ ছোপছোপ দাগ দেখা যায়, পরবর্তীতে ফুল পচে যায়।
এই রোগের প্রতিকার:
ক) গাছে নিয়মিত নজরদারি করুন। আক্রান্ত পাতাগুলি পরিষ্কার করে এবং আক্রান্ত গাছকে উপড়ে ফেলে নিরাপদ জায়গায় ফেলুন।
খ) গাছের পাতায় জল না দিয়ে গোড়ায় জল দেওয়া উচিত। যাতে গাছের পাতা, কুঁড়ি ও ফুল শুকনো থাকে এবং গাছের গোড়ায় জল না জমে। জল দিনের শুরুতে দিন যাতে গাছ পর্যাপ্ত সময় ব্যবহার করে গাছের গোড়া শুকনো রাখতে পারে।
গ) রোগমুক্ত চারা নার্সারি থেকে সংগ্রহ করুন।
ঘ) নির্দিষ্ট রোপণ দূরত্ব অনুসরণ করে গাছকে পর্যাপ্ত আলো বাতাস সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।
ঙ) অতিরিক্ত সার বিশেষত নাইট্রোজেনযুক্ত সার ব্যবহার বন্ধ করুন। জমি পরীক্ষা করে সার ব্যবহার করলে ভাল হয়।
চ) রোগের লক্ষণ বেশিমাত্রায় দেখা গেলে পর্যায়ক্রমে ১০ দিন অন্তর উল্লেখিত যে কোনও একটি ছত্রাকনাশক স্প্রে করুন। জলে দ্রবণীয় ক্যাপ্টেন ৫০% পাউডার ১ থেকে ১.৫ গ্রাম প্রতি লিটার জলে, গন্ধকগুঁড়ো ৮০% পাউডার ২.৫ গ্রাম প্রতি লিটার জলে, রোভরাল ৫০% পাউডার ১ থেকে ১.৫ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করুন।