বিশ্বদীপ দে: অনুষ্ঠানটা ছিল নিছকই একটা কমেডি ধাঁচের লেট নাইট শো। কেউ ভাবতেও পারেননি এমন অনুষ্ঠানে এক ভয়ংকর আশঙ্কার কালো ছায়া এভাবে ফুটে উঠবে! অনুষ্ঠানের সেদিনের অতিথিকে নানারকম প্রশ্ন করছিলেন উপস্থাপক অলিভার। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের প্রসঙ্গ উঠলে সেই অতিথি জানিয়ে দেন নিজের আশঙ্কার কথা। বলেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (Artificial Intelligence) কারণেই নাকি বিলুপ্তি ঘটতে পারে মানব সভ্যতার! তাঁর মুখ থেকে এই কথা শুনে সকলেই শঙ্কিত হয়ে পড়েন। কেননা কথাটি কোনও রাম-শ্যাম-যদু কিংবা টম-ডিক-হ্যারির নয়, এই বক্তব্য স্বয়ং স্টিফেন হকিং-এর (Stephen Hawking)! কিংবদন্তি বিজ্ঞানী আর নেই। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীতে ক্রমেই বাড়তে থাকা এআই-এর দাপটের মধ্যে যেন বারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে তাঁর সতর্কবার্তা।
ওই একবারই নয়। ‘লাস্ট উইক টুনাইট’ নামের সেই অনুষ্ঠান কয়েক মাসের মধ্যেই বিবিসির সঙ্গে কথোপকথনের সময়ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহারের উপর জোর দিয়েছিলেন হকিং। দাবি করেন, ”আপনারা যদি বুদ্ধিমান যন্ত্র তৈরি করতে থাকেন, একদিন তা আমাদের অস্তিত্বের জন্য়ই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।” হকিংয়ের সাফ কথা ছিল, কোনওদিন এমন এআই প্রোগ্রাম যদি বানিয়ে ফেলা যায়, যার চৈতন্য মানুষের চৈতন্যের সমকক্ষ, তাহলে অচিরেই তা মানুষকেও ছাপিয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠবে। কেননা যন্ত্রেরা যদি বুদ্ধিমান হয়, তবে তারা সহজেই অনেক কিছু শিখে যেতে থাকবে, এবং তা কাজে লাগিয়ে নিজেদের আরও উন্নত করে ফেলবে। তাদের বিবর্তন হবে খুব দ্রুত। তুলনায় মানুষের বিবর্তন যেহেতু অনেক ধীরগতিতে হয়, তাই তারা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না।
[আরও পড়ুন: গরু পাচার মামলায় অনুব্রত ‘ঘনিষ্ঠ’ আবদুল লতিফকে CBI তলব, নিজাম প্যালেসে হাজিরার নির্দেশ]
এটা ২০১৪ সালের ঘটনা। পরের বছর, ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসেই হকিং-সহ সারা বিশ্বের খ্যাতিমান এআই বিশেষজ্ঞরা একটি খোলা চিঠি লেখেন। হকিং ছাড়া বাকিদের মধ্যে সবথেকে পরিচিত মুখ ছিল এলন মাস্কের। সেই চিঠিতে বলা হয়েছিল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স থেকে সমাজ নিঃসন্দেহে বিরাট লাভবান হতে পারে। কিন্তু তবুও একে নিয়ে বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। খুঁটিয়ে দেখতে হবে এর ফলে কী কী ক্ষতি হতে পারে। সেই সময় ‘ফিউচার অফ লাইফ ইনস্টিটিউট’ নামের যে সংস্থা সভ্যতার ক্ষেত্রে যা ঝুঁকিপূর্ণ তাকে প্রশমিত করা নিয়ে কাজ করে সেই সংস্থার বোর্ডে ছিলেন হকিং-মাস্করা।
এরপর কেটে গিয়েছে আটটি বছর। রোবট আর ছেলেছোকরার মন ভোলানো ‘কলের পুতুল’ নেই। বরং তারাই মানুষকে পুতুল বানিয়ে ফেলতে পারে অদূর ভবিষ্যতে, এমন আশঙ্কা যেন আরও ঘনীভূত হচ্ছে। অতি সম্প্রতি এই বিষয়ের এক শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ ফের সেই কথাই বলেছেন। তিনি এআইয়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন পৃথিবীর বুকে গ্রহাণু আছড়ে পড়ার মতো বিপদের সঙ্গে! ম্যাক্স টেগমার্ক নামের ওই ব্যক্তি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির অধ্যাপক। তাঁর কথায় হকিংয়েরই বলে যাওয়া কথার অবিকল প্রতিফলন।
[আরও পড়ুন: জেলাশাসক খুনে সাজাপ্রাপ্ত প্রাক্তন সাংসদের মুক্তিতে বিতর্ক বিহারে, বিক্ষোভ দেখে ‘অবাক’ নীতীশ]
১৯৫০ সালে বিশ্ববন্দিত গবেষক অ্যালান টুরিং লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত গবেষণাপত্র ‘কম্পিউটিং মেশিনারি অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স’। সেখানে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, কম্পিউটার কি সত্যি চিন্তা করতে পারে? বলা বাহুল্য তখন কম্পিউটার বিজ্ঞানের একেবারে আদিম অবস্থা। প্রথম আধুনিক কম্পিউটার এনিয়াক তৈরি হয়েছে মাত্র বছর পাঁচেক আগে। সেই সময়েই এমন অমোঘ এক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করে দিয়েছিলেন এই দূরদর্শী মানুষটি। এই প্রশ্ন এবং তার উত্তর খোঁজা থেকেই জন্ম নিয়েছিল বিখ্যাত টুরিং টেস্ট। যেখানে একজন লোক একটি কম্পিউটার ও একজন মানুষকে একইধরনের কিছু প্রশ্ন করে কে মানুষ আর কে কম্পিউটার তা বুঝতে চেষ্টা করে। এমতাবস্থায় কম্পিউটার যদি তার দেওয়া উত্তরের মাধ্যমে নিজেকে মানুষ হিসেবে সনাক্ত করাতে পারে, তাহলেই সেই কম্পিউটারের মধ্যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স রয়েছে প্রমাণিত হয়।
আজও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের আলোচনায় টুরিং টেস্ট এক অপরিহার্য নাম। সেই শুরু। তারপর থেকেই বিজ্ঞানীরা অবিরত চেষ্টা করে চলেছেন যন্ত্রের মধ্যে বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটাতে। কয়েক দশকের গবেষণার শেষে রীতিমতো চমকপ্রদ সব উন্নতি হয়েছে গবেষণার। আর সেই উন্নতির রোশনাইয়ের আড়ালেই রয়ে গিয়েছে প্রশ্নটা। তাহলে কি মানুষ নিজেই ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন হয়ে দানব তৈরি করে ফেলছে, যে দানব একদিন টুঁটি টিপে ধরবে সভ্যতারই?
টেগমার্ক সাহেব সেই দিকেই আঙুল তুলছেন। তিনি জানিয়েছেন, কী করে এআইকে নিরাপদ অভিমুখে চালনা করা যায়, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের দারুণ সব পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু এআই সম্পর্কিত বিপদ কতটা ভয়াবহ হতে পারে, সেই আন্দাজ থাকা সত্ত্বেও এই বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগের জায়গাগুলো দিব্যি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি রীতিমতো হিসেব কষে বলছেন, এরই মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে জায়গায় পৌঁছেছে, সেই গতিবিধি বুঝিয়ে দিচ্ছে এর হাতে সভ্যতার ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে অন্তত ১০ শতাংশ। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই আশঙ্কাকে নিয়ে রীতিমতো রসিকতা করা হচ্ছে। ফলে বিপদ বাড়ছে। প্রশ্ন উঠছে, জল যখন নাকের উপরে উঠবে তখন কি আমরা বুঝতে পারব?
গত শতাব্দীর চারের দশকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাই-ফাই লেখক আইজ্যাক আসিমভ তাঁর ‘রান অ্যারাউন্ড’ গল্পে উল্লেখ করেছিলেন রোবোটিকসের তিনটি সূত্রের। সেই তিনটি ‘ল’ আসলে সুকৌশলে যন্ত্রের বুদ্ধিমত্তার ওপরে মানুষের নিয়ন্ত্রণের কথা বলে। কেননা ‘বুদ্ধিমান’ হয়ে পড়লে যন্ত্রও তো নিজের স্বার্থরক্ষার কথাই আগে ভাববে। এবং সেক্ষত্রে তার নিজের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে যদি মানুষের স্বার্থ বিঘ্নিত হয়, তাতে তাদের কিছু যাবে আসবে না। ভাবলে অবাক লাগে আসিমভ অতদিন আগেও কী নিপুণভাবে ভবিষ্যতের ‘থ্রেট’কে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন!
তবে এখনই অতটা ভয় পেতে রাজি নন সকলে। অনেকেরই মনে পড়ছে উনবিংশ শতকের আট ও নয়ের দশক জুড়ে থমাস এডিসন ও নিকোলা টেসলার ‘বৈদ্যুতিক লড়াই’-এর কথা। আসলে লড়াইটা ছিল ডিসি বনাম এসির মধ্যে। এডিসনের আশঙ্কা ছিল, এসির বড় বিপদ লুকিয়ে রয়েছে হাই ভোল্টেজের মধ্যে। কিন্তু তাঁর আশঙ্কাকে আমল দিতে নারাজ ছিলেন টেসলা। তিনি নিজের মতো গবেষণা চালিয়ে গিয়েছিলেন সদর্থক মনোভাব নিয়ে। শেষ পর্যন্ত এসি অর্থাৎ অল্টারনেটিং কারেন্ট সভ্যতার অগ্রগতিতে কেমন যুগান্তকারী ভূমিকা নিয়েছিল তা নিয়ে কোনও মন্তব্যের কি আর প্রয়োজন আছে? সেই ভাবেই এআই সংক্রান্ত সমস্ত আশঙ্কাও একদিন ভুল প্রতিপন্ন হবে, এমনটাই দাবি আশাবাদীদের। তাঁদের মতে, যন্ত্র মানুষের থেকে বেশি বুদ্ধিমান হয়ে উঠলে তারা আমাদের জন্য খুলে দিতে পারে অসীম সম্ভাবনার দরজা।
শেষ পর্যন্ত কী হবে তা সময়ই বলবে। তবে হকিংয়ের মতো মানুষ যখন সাবধান করে গিয়েছেন, তখন সেটাকে অগ্রাহ্য করে থাকাটা যে সচেতনতার বিষয় হবে না তা হলফ করেই বলা যায়। বহু গবেষকই কিন্তু সাবধান করে চলেছেন।