সরোজ দরবার: প্রতীক্ষা ছিল। প্রত্যাশা ছিল। সঙ্গে ছিল বিতর্ক আর আশঙ্কা। মনোজ বাজপেয়ীর ‘ফ্যামিলি ম্যান’ ওয়েব সিরিজের দ্বিতীয় সিজন ঘিরে কৌতূহলের পারদ ক্রমশ শীর্ষ ছুঁয়েছিল। সাধারণত দেখা যায়, প্রথম সিরিজে মাত করে দেওয়া ওয়েব সিরিজ দ্বিতীয় সিজনে তেমন দাগ কাটতে পারে না। অতৃপ্তি জেগে থাকে দর্শকমনে। ‘ফ্যামিলি ম্যান-২’ (Family Man 2) কি সেই পরিণতির দিকে এগোবে? এমন আশঙ্কা করছিলেন অনেকে। এর মধ্যেই আবার বর্তমান সিরিজের বিষয় নিয়ে ঘনিয়ে উঠেছিল বিতর্ক। তাতে মুক্তি নিয়েও কিছু মেঘ জমেছিল। সব মিলিয়ে ‘ফ্যামিলি ম্যান ২’ বেশ কিছুদিন ধরেই ছিল চর্চার বিষয়। অবশেষে দর্শকের চাহিদা পূরণ হল ৩ জুন রাতে। নির্ধারিত সময়ের খানিকটা আগেই মুক্তি পেয়েছে নয়া সিজন। ৯ পর্ব জুড়ে দর্শককে কানায় কানায় তৃপ্তির স্বাদই দিয়েছে তা।
না, কাহিনির কথা আগাম জানিয়ে স্পয়লার দেওয়ার উদ্দেশ্য নেই। ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে তা নিয়ে মজা-মশকরা শুরু হয়েছে। সুতরাং, নয়া সিজন দেখতে বসার আগে তা থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকুন। দুই দেশের পারস্পরিক চুক্তি, দেশের নিরাপত্তা, রাজনৈতিক নেতাদের জেদ, চরমপন্থীদের নৃশংশতা আর এই সবকিছুর সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে চলা দেশের নিরাপত্তার জন্য কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মীর নিরলস শ্রম ও আত্মত্যাগ – এই সূত্র ধরে একটি ওয়েব সিরিজের গল্প যেমন টানটান চমকপ্রদ হওয়া উচিত, এ গল্প ঠিক তেমনই। পরতে পরতে রাখা আছে থ্রিল। টানটান গল্পের গতি। জোরালো অভিনয়। সেই সঙ্গে চিত্রনাট্য জুড়ে হিউমারের দারুণ ব্যবহার। সব মিলিয়ে এই ধরনের ওয়েব সিরিজ থেকে দর্শকের প্রত্যাশা যেমন থাকে, পরিচালক রাজ-ডিকে জুটি ঠিক তেমন ভাবেই সাজিয়ে উপহার দিয়েছেন নয়া সিজন। ফলে, এবারও দর্শকের আশাপূরণের ট্র্যাডিশন বজায় থাকছে।
গল্প ছাড়া নয়া সিজন সম্পর্কে আর যে পাঁচটি কথা না জানলেই নয় –
১) আগের সিজনের গল্প যেখানে শেষ হয়েছিল, সেই অধরা কাহিনির উপসংহার কি নতুন সিজনে পাওয়া যাবে? ট্রেলার দেখে এর আঁচ পাওয়া যায়নি। অনেকটাই নতুন গল্প বলে মনে হয়েছিল। হ্যাঁ, এখানে গল্প নতুন। নতুন করে চরমপন্থী বনাম দেশের নিরাপত্তাকর্মীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু। তবে গতবারের কাহিনির পরিণতিও কিন্তু এখানে আছে। যেখানে তা শেষ হয়েছে, অনেকটা সেই পথ ধরেই এগিয়েছে নতুন গল্প।
[আরও পড়ুন: মা হতে চলেছেন নুসরত? সম্পর্কের টানাপোড়েনের মাঝে নয়া গুঞ্জনে শোরগোল]
২) কেবলমাত্র সাফল্য নয়, ব্যর্থতাও জীবনের অঙ্গ। তা স্বীকার করে নিতে হয়। এই কথাটি বেশ অন্তর্লীন ভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছেন পরিচালকরা। এককালে বলিউডের হিরোকেন্দ্রিক সিনেমায় নায়ককে জিততেই হত। এখানেও শেষমেশ টিম শ্রীকান্তকে জয় হাসিল করতে হয়। কিন্তু তার ভিতর ভিতর কোথাও থেকে যায় ব্যর্থতার গল্পগুলোও। তা যে রক্তক্ষরণ ঘটায় গোপনে, সেই সত্যিটুকু এখানে অস্বীকার করা হয়নি। যত আধুনিক সরঞ্জামই থাকুক হাতে, যত সাহস, বীরত্ব থাকুক না কেন, জীবনের সাপলুডোতে কখনও মই, কখনও সাপের মুখ থাকে। টাস্কের দায়িত্বে থাকা অফিসারদের ক্ষেত্রেও যেমন তা সত্যি, তেমনই সত্যি বোধহয় আধুনিক জীবনের মানুষদের ক্ষেত্রেও।
৩) শ্রীকান্ত ও তাঁর স্ত্রী সুচিত্রার জীবনে সম্পর্কের টানাপোড়েন গত সিজনেই দেখানো হয়েছিল। এই সিজনে তা অনেকটা জায়গা জুড়ে থেকেছে। গল্পের প্লটের পাশাপাশি এই সাবপ্লট যত এগিয়েছে তত আধুনিক জীবনের জটিলতার মানচিত্র স্পষ্ট হয়েছে। বস্তুত, জীবন কেবলমাত্র সাদা-কালোর উজ্জ্বল ছবি নয়, তার ভিতর যে ধূসর অঞ্চল থাকে, তাও অস্বীকারের জায়গা নয়। সম্পর্কের এই গল্পটি বারবার সেই দিকটাই তুলে ধরে।
৪) এই ওয়েব সিরিজের একটি স্তম্ভ যদি গল্প হয়, অন্যটি সন্দেহাতীত ভাবেই অভিনয়। শ্রীকান্ত চরিত্রে মনোজ বাজপেয়ী (Manoj Bajpayee) যে পরিচালকের তুরুপের তাস, সে-কথা আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই। ঠান্ডা মাথার একজন টাস্কের নিরাপত্তাকর্মী, যার মুখের নির্ভয় রেখায় ধরা পড়ে ইস্পাতকঠিন একজন মানুষ। সেই তিনিই যখন একজন ক্লান্ত স্বামী, কিংবা বাবা, অথবা রসিক বন্ধু তখন যেন একেবারে অন্য এক মানুষ – সব মিলিয়ে যতক্ষণ মনোজ পর্দায় থেকেছেন দর্শক চোখ ফেরাতে পারেননি। এই সিরিজে তাঁর যা দায়িত্ব ছিল, তা তিনি শুধু পূরণ করেননি, তাঁর মতো তুখোড় অভিনেতা জীবনের এই পর্বে পরিমিত ও মার্জিত অভিনয়কে একটা অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছেন এখানে।
[আরও পড়ুন: ‘ফ্যামিলি ম্যান ২’ সিরিজে মহিলা বাঙালি প্রধানমন্ত্রীর অনুপ্রেরণা কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?]
তবে, এই সিনেমায় দেখতে হয় গেরিলা ট্রেনিং নেওয়া চরমপন্থীর চরিত্রে অভিনয় করা সামানথা আক্কিনেনিকে (Samantha Akkineni)। শারীরিক অভিনয়, দৃষ্টি, অ্যাকশন – সব মিলিয়ে মনোজ বাজপেয়ীর সমান্তরালে নজর টেনে রাখার মতোই অভিনয় করেছেন তিনি। উল্লেখ করতে হয় শ্রীকান্তের বন্ধুর চরিত্রে শরিব হাসমির অভিনয়ও। মূলত তাঁর এবং মনোজ বাজপেয়ীর হাত ধরেই এই থ্রিল-অ্যাকশনের ভিতরও হিউমার ডানা মেলেছে চমৎকার। সুচিত্রা চরিত্রে প্রিয়ামণি, বাঙালি প্রধানমন্ত্রীর চরিত্রে সীমা বিশ্বাস ও অন্যান্য চরিত্রাভিনেতারা যথাযথ।
৫) লড়াই, দৌড়, চরমপন্থী হামলা রুখে দেওয়ার টানটান ঘটনাবলির ভিতরও এই সিরিজ আসলে বলে যায় সুখ-অসুখের গল্পও। আমরা যেন ভুলে না যাই, সিরিজের নাম ‘ফ্যামিলি ম্যান’। একজন মানুষের কাছে সুখের সংজ্ঞা ঠিক কী, তা এককথায় বলা যায় না। কেউ জোর করে সুখী হওয়ার চেষ্টা করে। যেমন শ্রীকান্ত। এই সিরিজের এক পর্বে দেখা যাবে, তিনি আইটি কোম্পানির চাকরি করছেন। আবার, একটা সময় দেখা যায়, তাঁর স্ত্রী নিজের সংসার সন্তান নিয়ে তেমন সুখী হতে পারছেন না। তিনি সুখ খুঁজছেন অন্য সম্পর্কের পরিসরে। এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের উত্তর যে খুব নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে, তা নয়; তবে, এই উতরাই চড়াই মিলেই যে জীবনের একটা দৌড় ও মোকাবিলার গল্প চলতে থাকে, এই সিরিজে সেই কথাটুকুও খুব সুচারুভাবেই বলা আছে।
সব মিলিয়ে ‘ফ্যামিলি ম্যান ২’ দেখতে ভালো লাগে। টানটান গল্প, তুখোড় অভিনয় যেমন দর্শককে টেনে রাখে, তেমনই এই গল্পের মূলস্রোতের পাশাপাশি জীবনের সুখ-অসুখ, দ্বিধা-দ্বন্দ্বের যে ছোট ছোট গল্পগুলি জেগে থাকে, তাও দর্শককে ভাবিয়ে তোলে।
————————-
ওয়েব সিরিজ – ফ্যামিলি ম্যান ২
অভিনয় – মনোজ বাজপেয়ী, সামানথা আক্কিনেনি, প্রিয়ামণি, সীমা বিশ্বাস।
পরিচালক – রাজ ও ডিকে
প্ল্যাটফর্ম – আমাজন প্রাইম