দিব্যেন্দু মজুমদার, হুগলি: হুগলির ধনিয়াখালির প্রজ্ঞা দেবনাথই যে বাংলাদেশী জঙ্গি সংগঠনের সক্রিয় সদস্য আয়েশা জন্নত মোহনা তা এখন দেবনাথ পরিবারের কাছে যেন আতঙ্ক। এলাকার মানুষ এখনেও বিশ্বাস করতে পারছেন না তাদের গ্রামের প্রজ্ঞাই সেই জঙ্গি যাকে শুক্রবার বাংলাদেশে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জঙ্গি কার্যকলাপের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে।
[আরও পড়ুন: ধর্মান্তরিত হয়ে প্রজ্ঞা হল নিও জেএমবি জঙ্গি আয়েশা, বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হুগলির যুবতী]
ধনিয়াখালি থানার ভান্ডারহাটির কেশবপুরের এক প্রত্যন্ত এলাকায় এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে কোনোমতে অ্যাসবেস্টসের চালের ঘরে দিন কেটে যাচ্ছিল দেবনাথ দম্পতির। অত্যন্ত নিম্নবিত্ত পরিবারে স্বামী প্রদীপ দেবনাথ ১০০ দিনের কাজ করে কোনোমতে চারটে প্রানীর পেট চালাতেন। মা গীতা দেবনাথ ছেলেমেয়েকে পড়াশুনা শিখিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু সামান্য আয়ে তা কখনেওই সম্ভব ছিল না। তাই গীতাদেবী ছেলেমেয়ের পড়াশুনার জন্য নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছিলেন শাড়ির বোঝা। আর লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেই শাড়ি বিক্রি করে ছেলেমেয়ের পড়াশুনার খরচ যোগাতেন। নিজের শিক্ষা ও বুদ্ধির জোরে গীতাদেবী পরে ১০০ দিনের কাজে সুপারভাইজার হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। আর দশটা অভাবী পরিবারের মতো মেয়েকে অল্প বয়সে মেয়ে প্রজ্ঞাকে বিয়ে দিয়ে জীবনটাকে শেষ করে দিতে চাননি। চেয়েছিলেন প্রজ্ঞা নিজের পায়ে দাঁড়াক। বর্তমান এই বিশ্বে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে চিরকাল কষ্টের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে। তাই ছেলে মেয়ের পড়াশুনার দিকে সদা সতর্ক নজর ছিল গীতাদেবীর। ভান্ডারহাটি বি এম হাই স্কুল থেকে কলা বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাশ করার পর প্রজ্ঞা ধনিয়াখালি কলেজে সংস্কৃতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত পড়াশুনা ঠিকঠাকই করছিল প্রজ্ঞা। তৃতীয় বর্ষের পড়াকালীন ২০১৬ সালে হঠাৎই নিখোঁজ হয়ে যায় প্রজ্ঞা। কিন্তু আজ সকালে হঠাৎই জঙ্গি কার্যকলাপের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশে মেয়েকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে শোনার পরই আর্তনাদ করে ওঠেন গীতা দেবী। শুক্রবার বিকেলে ঢাকার সদরঘাট থেকে নিউ জেএমবি জঙ্গি সংগঠনের সদস্য আয়েশা জন্নত মোহনা ওরফে প্রজ্ঞাকে গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশের সিটিটিসি।
শনিবার সকালে মেয়ের গ্রেপ্তারের খবর লোকমুখে শোনার পর থেকেই দেবনাথ পরিবারের মাথার উপর যেন বাজ ভেঙে পড়েছে। প্রজ্ঞার মা গীতাদেবী জানান তার শাশুড়ী ২০১৬-র ২৪ আগস্ট মারা যান। তার ঠিক এক মাস পরে ২৪ সেপ্টেম্বর হঠাৎই মেয়ে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে যায়। ধনিয়াখালি থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করার পর বহু খোঁজাখুঁজি করার পরও মেয়ের সন্ধান পাওয়া যায় নি। তারপর প্রায় বছর দেড়েক বাদে মেয়ে একদিন তাকে ফোন করে জানায় সে বাংলাদেশে আছে। সেখানে সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। মায়ের মন, তাই মেয়েকে ফোনে বারবার অনুরোধ করেছিলেন তুই আমাদের কাছে ফিরে আয়। কিন্তু এরপরই মেয়ে ফোনের লাইন কেটে দেয়। তারপর থেকে একবারের জন্যও আর মেয়ে তাদের ফোন করে নি। গীতাদেবী জানান অভাবের সংসার। সেরকম আর্থিক সামর্থ্য নেই তাই ইচ্ছে থাকলেও বাংলাদেশে গিয়ে মেয়ের খোঁজ নিতে পারেন নি। বর্তমানে লকডাউনের কারণে শাড়ির ব্যবসা লাটে উঠেছে। তার উপর মেয়ে জঙ্গি এই খবর শোনার পর থেকেই মা গীতা দেবী শুধু কাঁদতে কাঁদতে একটাই কথা বলছেন এত কষ্ট করে মেয়েকে মানুষ করলাম মা বাবার কথা একবারও ভাবল না। বাবা প্রদীপ দেবনাথের সাফ জবাব-যেমন কর্ম তেমন ফল। ও যদি জঙ্গি হয় তবে তার সাজা ওকে পেতেই হবে।
পাশাপাশি সম্প্রতি জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ডানকুনিতে দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়েতে সিগন্যাল পয়েন্টের কাছে কলকাতা পুলিশ ও ডানকুনি থানার পুলিশ যৌথ অভিযান চালিয়ে কলকাতাগামী একটি বাস থেকে বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুজাহিদিনের সদস্য কুখ্যাত জঙ্গি শেখ রেজাউলকে গ্রেপ্তার করে। ধৃত জঙ্গি শেখ রেজাউলের বাড়ি বীরভূমের ইলমবাজার এলাকায়। সংগঠনের সদস্যদের কাছে কিরণ, রুটু বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল রেজাউল। বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনের হয়ে মূলত তহবিল সংগ্রহ ও সদস্য সংগ্রহের গুরু দায়িত্ব ছিল রেজাউলের উপর। সেক্ষেত্রে পুলিশের আধিকারিকদের অনুমান রেজাউলের সাথে ধনেখালির প্রজ্ঞার কোনো যোগাযোগ থাকার সম্ভবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে এই বিষয়ে বাংলাদেশের পুলিশই আরও ভাল করে বলতে পারবে বলে তারা জা্নান। সেক্ষেত্রে নিখোঁজ হওয়ার পর কোন পথে প্রজ্ঞা বাংলাদেশ গেল এবং কার সাহায্যে সে সেখানে পৌঁছাল এ নিয়ে পুলিশের মনেও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
[আরও পড়ুন: ব্রিটেনে ফিরতে পারবে শামিমা, ISIS ‘জেহাদি বধূ’কে স্বস্তি দিল আদালত]
The post অভাবের সংসারে প্রজ্ঞাই ছিল আশা, ‘জঙ্গি’ মেয়ের কীর্তিকলাপে হতবাক পরিবার appeared first on Sangbad Pratidin.