আপাত নিরীহ, নিরামিষ, তুচ্ছ এক বস্তুর আড়ালে চাপা দিয়ে রাখা দুর্মূল্য কোনও বিষয় বা বস্তুর কথা বোঝাতে বাঙালি ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’ নামক প্রবাদ ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু, এই নগণ্য শাক-পাতারও এক রাজকীয় মর্যাদা রয়েছে। শুধুমাত্র পেট ভরানোর খাদ্যদ্রব্য হিসাবে নয়, শরীরের অত্যাবশ্যক পুষ্টির জোগান সুনিশ্চিত করতে শাকপাতার জুড়ি মেলা ভার। লিখেছেন ব্রেনওয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ এগ্রিকালচারের সহকারী অধ্যাপক ড. সৌরভ রায়।
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ-এর বিজ্ঞানীদের মতে, একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর জন্যে দৈনিক ৩০০ গ্রাম সবজি খাওয়া উচিত, তার মধ্যে ১২৫ গ্রাম শাক-পাতা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। তাই, বোঝাই যাচ্ছে, পুষ্টি চাহিদা মেটানোর জন্যে শাকপাতার ভূমিকা কতটা! নানা ঔষুধি গুণে ভরপুর এসব শাক-পাতা আগেকার দিনের মানুষ ব্যবহার করত রোগব্যাধির দাওয়াই হিসেবে। তাই, ডাক্তার, হাসপাতাল এসবের দিকে বেশি একটা ছুটতে হত না। কিন্তু, কালের অমোঘ নিয়মে, সেসব আজ স্মৃতির পাতায় স্থান করে নিয়েছে।
নগরায়ণ, শিল্পায়ন, জনবিষ্ফোরণ, পরিবেশ দূষণ এবং বাজারী অর্থনীতির চাপে ফসল বৈচিত্র্য কমে গিয়েছে। মাঠ ঘাট, খাল, বিলে অবহেলায় বেড়ে ওঠা শাক পাতার আধিক্যে ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে, বাঙালির শাক বৈচিত্র্য হ্রাস পেয়েছে শঙ্কাজনকভাবে। তাই পূর্বপুরুষদের পছন্দের তালিকায় বিরাজ করত যেসব শাক দীর্ঘদিনের অনভ্যাসের দরুণ বাঙালি বেমালুম ভুলতে বসেছে সেসব আদৌ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা যায় কি না !এই মুহূর্তে আমরা যখন খাদ্যের পরিমাণ এবং পুষ্টির মান নিয়ে উদ্বিগ্ন হচ্ছি, সেই সময়ে পুকুর পাড়ে, পতিত জমিতে আড়ালে আবডালে বেড়ে ওঠা শাকগুলো কিন্তু এই দুই চাহিদাই মেটাতে পারে।চলুন জেনে নিই, বাংলার কিছু অবহেলিত শাক ও তার গুণাবলী সম্পর্কে।
কলমী শাক (Ipomea aquatica)
জলা জমিতে কলমী শাক জন্মায়। এই শাক ভেজে বা ঝোল করে খাওয়া যায়। হিস্টিরিয়া ও মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত রোগীদের এই শাকের রস সেবন করালে উপকার পাওয়া যায়। এই শাক প্রসূতি মায়েদের বুকের দুধ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
হিঞ্চে (Enhydra fluctuans)
এই শাকের রস ২-৪ চা চামচ খালিপেটে সেবন করলে পিত্ত প্রকুপিত রোগ উপশম হয়।
শুষনি (Marsilea minuta)
ধান ক্ষেতের আশেপাশে কিংবা জলাশয়ের ধারে আপন মনে বেড়ে ওঠে এই শাক। অনিদ্রায় ভোগা রোগীদের মোক্ষম দাওয়াই এই শাক। হজম শক্তি বৃদ্ধি করতে ও দেহের ওজন কমাতে এই শাকের জুড়ি নেই।
[আরও পড়ুন: স্পেনে জন্ম হলেও গ্রামবাংলায় ব্যাপক জনপ্রিয় শাক, জেনে নিন তার সাত-সতেরো]
গিমে শাক (Glinus lotoides)
এই শাক আলু বা বেগুন দিয়ে ভেজে তরকারি করে পরিবেশন করা হয়। মহিলাদের প্রসবের পর যদি স্রাব বন্ধ হয়ে যায়, তখন এর রস দুই থেকে চার চামচ মাত্রায় দিনে দুই থেকে তিনবার সেবন করলে স্রাব পুনরায় হয় এবং জরায়ু পরিষ্কার করে দেয়।
থানকুনি (Centella asiatica)
এই শাক যকৃৎকে ভাল রাখে, প্রস্রাব পরিষ্কার রাখে। রক্ত আমাশয়ে ভোগা রোগীদের অন্যতম ভেষজ ওষুধ এই শাক।
ব্রাহ্মী শাক (Bacopa monnieri)
স্মৃতি শক্তি বৃদ্ধিতে, স্নায়বিক দুর্বলতা কাটাতে, বুকে সর্দি বসে গেলে এই শাক ব্যবহার করা হয় ।
কুলেখারা শাক(Asteracantha longifolia)
লিভারের সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের জন্যে খুব উপকারী এই শাক। রক্তাল্পতায় ভোগা রোগীদের শরীরে আয়রনের মাত্রা বাড়ায় এই শাক।
লুনে শাক (Portulaca oleracea)
হাত-পা জ্বালায় এই শাকের রস ব্যবহার করলে উপসম পাওয়া যায়। হজম শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে এই শাক।
পুদিনা (Mentha arvensis)
এর পাতা ও সরু কান্ড পরিমাণ মত নুন, চিনি, লেবু, লঙ্কা সহযোগে চাটনি বানিয়ে খাওয়া হয়। গ্রীষ্মকালে মিছরির সরবতে এই পাতা বেঁটে মিশিয়ে পান করলে শরীর ঠাণ্ডা থাকে ও পেট ভাল থাকে।
মেথি( Trigonella foenum-graecum)
চুল পড়া প্রতিরোধে সাহায্য করে, পিত্ত ভাল রাখে। মেথির বীজ ভেজানো জল খেলে মধুমেহ রোগ সারে।
আমরুলী শাক (Oxalis corniculata)
সেদ্ধ করে ভাতে মেখে খেলে ক্ষুধা বৃদ্ধি করে। অম্বলের সমস্যায় ভুগতে থাকা রোগীদের অম্বলের সমস্যা দূর করে এই শাক।
টক পালং (Rumex vesicarius)
বমি অনর্গল হতে থাকলে, এর রস খাওয়ালে বমি বন্ধ হয়। মৌমাছির কামড়ে বিষের জ্বালা হলে এর রস লাগালে ভাল ফল পাওয়া যায়।
নটে শাক (Amaranthus tricolor)
নটে শাক ভেজে বা তরকারি করে খাওয়া হয়, বেশ মুখরোচক। হজম শক্তি বাড়ায় এবং প্রস্রাব পরিষ্কার রাখে।
শুলফা শাক (Anethum graveolens)
এই শাক বেঁটে গরম তেলের সাথে মিশিয়ে কাঁচা ফোঁড়ায় প্রলেপ দিলে ফোঁড়া পাকিয়ে ফাটিয়ে দেয়। এটি বায়ুনাশক। হজম করায়।
বেথুয়া শাক (Chenopodium album)
এই শাক মূলত ভেজে খাওয়া হয়। এটি কৃমিনাশক। ছাগলের দুধের সাথে বেথুয়া শাকের রস পান করলে অর্শের রক্তপাত বন্ধ হয়।
পলতা শাক (Trichosanthes divica)
পটল গাছের পাতাকে পলতা বলে। এই শাক বেসন দিয়ে ভেজে বড়া করে খাওয়া হয়। কৃমি, কাশি, জ্বর সারায় ।
লাফা (Malva verticillata)
এর পাতা ও কচি ডগা রান্না করে শাক হিসেবে খাওয়া হয়। এর শুষ্ক পাতার ছাই চর্মরোগ বিনাশ করে। ক্ষেত, বাগান, পথঘাট থেকে সংগ্রহ করার পরে শাকপাতাতে নানা ধরনের ময়লা, ক্ষতিকর জীবাণু, পোকামাকড় থেকে যায়। অপরিষ্কার শাকপাতা রান্না করে খেলে পেটের অসুখ হতে পারে। তাই, শাকপাতা রান্নার আগে সেগুলো পরিষ্কার জল দিয়ে ধুয়ে নেওয়া বাঞ্ছনীয়। ছাকনিতে রেখে বা শাকপাতা কাপড়ে বেঁধে ফুটন্ত জলে ১০-১৫ সেকেন্ড করে তিন থেকে চার বার চুবিয়ে নিলে জীবাণু নষ্ট হয়। এর ফলে শাকটি সহজপাচ্য হয়। শাকের ভিতরে ভিটামিন, খনিজ পদার্থ গুলোর মাত্রাও ঠিক থাকে। খুব বেশি করে তেলে ভেজে শাক খেলে শাকের গুণাবলী নষ্ট হয়ে যায়।
উল্লেখ্য, বিভিন্ন শাকের স্বাদ আলাদা, রন্ধন প্রণালীও আলাদা। শাক খাওয়ার এলাকাগত অভ্যাসও ভিন্ন। শাক খাবার অভ্যাসকে ফিরিয়ে আনতে হলে বাংলার শাক বৈচিত্র্য সম্পর্কে অবগত হতে হবে, অবগত হতে হবে এদের গুণাগুণ ও রন্ধন প্রণালী সম্পর্কেও। পরিবেশের ভারসাম্য হারিয়ে যাওয়ার দরুন বিলুপ্তির পথে আজ বাংলার শাক ভাণ্ডার। তাদের জন্মানোর উপযুক্ত পরিবেশ আবার তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নেওয়াটা আমাদের একান্তই প্রয়োজন, আর এ বিষয়ে আমাদের চেতনার উন্মেষ ঘটানো কাম্য।