অর্ণব আইচ: পড়ে থাকতে থাকতে ‘গামছা’গুলো বোধহয় নষ্টই হয়ে গেল। খারাপ হয়ে গেল রাতজাগার অভ্যাসটাও। নাহলে, এই শীতকালটাই যে মোক্ষম সময়। ঠান্ডা যত বাড়বে, লেপমুড়ি দিয়ে তত বেশি ঘুমোবে গেরস্তরা। আর ততই কাজের সুবিধা হবে ঘুটিয়ারি শরিফের রাজু বা তালদির সামিরের। কিন্তু কোথায় কী? শেষ এক মাস ধরে রাতের কাজকর্ম যে প্রায় বন্ধ নিশিকুটুম্বদের। তাই রাতের টহলদার পুলিশও যেন কিছুটা নিশ্চিন্ত।
লালবাজারের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বকাপ ফুটবল (FIFA World Cup) শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় এক-চতুর্থাংশে নেমে গিয়েছে রাতে চুরির ঘটনা। যেখানে সারা বছরই গড়ে প্রত্যেক রাতে চার থেকে পাঁচটি করে চুরির ঘটনা শহরে ঘটে, সেখানে বিশ্বকাপের (Qatar World Cup) শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত রাতে গড়ে একটি বা কখনও বড়জোর দু’টি করে চুরির ঘটনা ঘটছে। প্রায় ভোররাত পর্যন্ত ফুটবলপ্রেমীদের উল্লাস বাদ সেধেছে পেশাদার দুঁদে চোরদের কাজেও। সাধারণত তাদের কাজটাই যে একটু অন্য ধরনের। দিনের বেলায় কখনও নিজেরা, আবার কখনও ‘টিপার’রা খোঁজ নেয়, কোন বাড়িতে লোক নেই, অথবা কোন ফ্ল্যাটে উঠে দরজা দিয়ে ঢুকে চুরি করা সোজা। কখনও আবার খোঁজ নিতে রাতও কাবার হয়ে যায়। তার পর শুভরাত দেখে চারটি খেয়ে হাতে ‘গামছা’ নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়া।
[আরও পড়ুন: হাই কোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও সন্ধেয় মাইক ব্যবহারে ‘না’, কাঁথিতে শুভেন্দুর সভা নিয়ে ফের আদালতে BJP]
উল্লেখ্য, এই ‘গামছা’ মোটেই গা মোছার কাপড় নয়। এই ‘গামছা’ই হল নিশিকুটুম্বদের প্রাণভোমরা। চোরদের ‘গামছা’ হচ্ছে বিভিন্ন মাপের লোহার শিক ও মোটা কাঠি। সঙ্গে তাদের কয়েক রকমের ‘গামছা’ থাকে। বাড়ির তালা খোলা বা ফ্ল্যাটের দরজার লক ভাঙার জন্য একেক রকমের ‘গামছা’। আবার সিন্দুক বা আলমারি খোলার জন্য তাদের কোঁচড়ে থাকে অন্য রকমের ‘গামছা’ও। টিকিট কাটার বালাই নেই। শেষ বা তার আগের ট্রেন ধরে নেমে পড়ার পালা নিজের পছন্দমতো স্টেশনে। তার পর হাঁটতে হাঁটতে ‘টার্গেট’-এ থাকা পাড়ায় পৌঁছে যাওয়া। শুধু কখনও সখনও রাস্তার কুকুরগুলো একটু বিরক্ত করে, এই যা। এর পর সুযোগ বুঝে পাঁচিল টপকে অথবা রেন পাইপ বেয়ে ঢুকে ‘গামছা’র কল্যাণে জিনিসপত্র হাতিয়ে প্রথম ট্রেন ধরে গা-ঢাকা দেওয়া। কেউ আবার মোটা দাঁও মারতে না পারলেও ছিঁচকে চুরিতে ছোটখাটো জিনিসপত্র, বা সাইকেলই সই।
কিন্তু চার বছর অন্তর এই সমস্যার সামনে পড়তেই হয় তাদের। যেমন সমস্যা হয়েছে প্রায় মাসখানেক ধরে। কোথায় শীতের রাতে লোকে আলো বন্ধ করে ঘুমোবে, তা নয়। রাত বারোটার পর প্রায় সব বাড়ির আলো জ্বালা। বাড়ির ভিতর থেকে টিভির শব্দ। শুধু তাই নয়, পাড়ার ক্লাবে ক্লাবে সারা রাত ধরে টিভির সামনে ভিড়। আর ব্রাজিল হোক বা আর্জেন্টিনা, কেউ গোল দিলেই চিৎকার করে পাড়া মাথায় করা। চিৎকার বাড়ির ভিতর থেকেও। আর প্রিয় দল জিতলে কথাই নেই। বাজি ফাটানো, আর ব্রাজিলের ভুভুজেলার মতো প্লাস্টিকের বড় বড় ভেঁপু ক্রমাগত বাজিয়েই যাওয়া। প্রিয় দলের পতাকা নিয়ে চিৎকার করতে করতেই পুরো পাড়ায় দু’পাক ঘুরে আসা। খেলার পর এসব সারতে সারতে প্রায় ভোররাত। জোয়ান খেলাপ্রেমীদের এই উৎসাহে ইন্ধন পাড়ার প্রবীণদেরও। কিন্তু লালবাজারের গোয়েন্দা আধিকারিকদের মতে, কলকাতায় গত এক মাসে চুরির পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে যে, সবার এই উৎসাহ কাজে বড্ড বাধা দিয়েছে রাতের অতিথিদের। রসিকতা করে এক পুলিশ আধিকারিক বলেন, যদি সারা বছর বিশ্বকাপ হয়, তবে হয়তো চুরিই বন্ধ হয়ে যাবে। তবে এবার বিশ্বকাপ শেষ। গভীর রাতে ঘুমিয়ে পড়বে কলকাতা। তার ফলে যাতে চোরদের বাড়বাড়ন্ত না হয়, তার জন্য সতর্ক হয়েই টহল দেবে পুলিশ।