shono
Advertisement
Athhoi Movie

রগরগে যৌনতা, দগদগে ঈর্ষা! 'অথৈ' কি আসলে আমাদের আয়না? পড়ুন রিভিউ

ভিস‍্যুয়ালই এই ছবিকে দিনের শেষে জীবন্ত করে তোলে।
Published By: Akash MisraPosted: 11:57 AM Jun 13, 2024Updated: 11:57 AM Jun 13, 2024

প্রিয়ক মিত্র: সত্যি, মানুষ কী আশ্চর্য প্রাণী! যুক্তিবুদ্ধিতে কত মহৎ, কী অসীম তার ক্ষমতা, আকৃতিতে, চলনবলনে, কর্মে কী স্বতঃস্ফূর্ত, কী সম্ভ্রম-জাগানো, বোধে সে দেবতুল‍্য। পৃথিবীর সৌন্দর্য। জীবজগতের আদর্শ। তাও, এই ধুলোর সার আমি বুঝি না।- বিস্ময় করেছিল হ‍্যামলেট। স্বপন চক্রবর্তী বলেছিলেন, ইউরোপীয় রেনেসাঁ-র বিপন্নতা থেকে উঠে আসছে এই কথা। কিন্তু এই ধূসর মহত্ত্ব ও সংশয়ের ধুলোবালি কি শাশ্বত? আজ যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নীল নকশায়, ভার্চুয়াল অভ‍্যেসে মানুষের চরিত্র ক্রমে একরৈখিক; ক্রমশ অলৌকিক হয়ে উঠছে আমাদের চেনা আলো-অন্ধকারের রক্তমাংস, তখন কি শেক্সপিয়রীয় ট্র‍্যাজেডির চরিত্রকে আমরা দেখতে পাব আমাদের চারপাশে চোখ রাখলে? না কি আদতে তা হয়ে উঠবে কাকতাড়ুয়া? যার নিশ্চল অস্তিত্বের ভেতর আমাদের ভয়, ঈর্ষা, সন্দেহ জমে উঠবে বারুদের মতো?

Advertisement

অরসন ওয়েলস, স্টুয়ার্ট বার্জ (সরাসরি জন ডেক্সটারের মঞ্চায়ন থেকে, নামচরিত্রে লরেন্স অলিভিয়ের) বা অলিভার পার্কারদের পরিচালনায় যেমন শেক্সপিয়রীয় নাট‍্য উঠে এসেছে পর্দায়, তেমনই নির্বাক ছবি 'কার্নিভাল' থেকে 'অল দ‍্য নাইট লং' হয়ে বিশাল ভরদ্বাজের 'ওমকারা'; কখনও ওথেলোর মঞ্চায়ন, কখনও জ‍্যাজ দুনিয়ার প্রেক্ষিতে নিও নয়‍্যার, কখনও উত্ত‍রপ্রদেশের বাহুবলি জগত- নানা পটভূমিতে এই ট্র‍্যাজেডির রূপায়ণ ঘটেছে, ঘটে চলেছে। এত বছর ধরে প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকা এই নাটকের সারে আদতে কীসের অবস্থান? প্রেম, যৌন ঈর্ষা না কি যুদ্ধ, বর্ণবিদ্বেষ? পল রোবসন মনে করেছিলেন, 'ওথেলো'-র গায়ের রং আসলে নেহাতই আনুষঙ্গিক। তাহলে কি দিনের শেষে দুই পুরুষের অসূয়া ও চাপা হিংসার আখ্যান 'ওথেলো'? মানবিকতার সীমা ছাড়িয়ে যা চিনিয়ে দেয় তার পাশবিক অন্দরকে? তাই 'সপ্তপদী'-র প্রেমের পূর্বপ্রস্তাবও রচিত হয় 'ওথেলো'-র দৃশ‍্যসূত্রে? তাই 'ওথেলো'-কে অন্য সময়ের ক‍্যানভাসে, আধারিত চরিত্রদের মধ্য দিয়ে নিয়ে আসার সময় সেই সহিংসতাই হয়ে ওঠে কেন্দ্রীয় ঘুঁটি?

[আরও পড়ুন: ভেজা শরীরে সিগারেটে সুখটান বিক্রমের, ভিডিও শেয়ার করে বিশেষ ঘোষণা অভিনেতার]

'ওথেলো'-র নেপথ‍্যে ছিল একটি যুদ্ধ। অটোমানদের সাইপ্রাস দখল ঘিরে সংঘর্ষ, ভেনেশিয়ানদের সঙ্গে। 'অথৈ' নাট‍্য ও এখন চলচ্চিত্রের লেখক ও নির্দেশক অর্ণ মুখোপাধ্যায় এক অন‍্য যুদ্ধের কথা ভেবেছেন। যে যুদ্ধ ভারতীয় উপমহাদেশের আবহমানকালের। যে যুদ্ধে পরাজিত কেবল নয়, রক্তাক্ত, দগ্ধ হয়ে এসেছে এই দেশের দলিতরা। রোহিত ভেমুলা থেকে হাথরস, বারবার যে দৃষ্টান্ত দগদগে হয়ে উঠেছে। 'অথৈ' নাট‍্যে এক দৃশ্যে অথৈ লোধা (এই ভঙ্গিকরণে ওথেলোর নামান্তর) স্পষ্টভাবে সেই রাজনৈতিক বাস্তবতার কথা বলে তার স্ত্রী দিয়াকে (ডেসডিমোনা)। 'অথৈ' ছবিতে তা অন্তঃসলিলা। দিদাকে ডাইনি বলে পুড়িয়ে দেওয়া, মায়ের শ্রমের মূল্য না পাওয়া ও চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর ইমেজ বারবার ফিরে আসে ছবিতে। কিন্তু যুদ্ধ একটাই নয়, যুদ্ধ চলছে গাজা-য়, 'অল আইজ অন রাফা' স্পন্দিত হচ্ছে আবিশ্ব। শিশুমৃত্যুর হার বাড়ছে, গলে যাচ্ছে হিমবাহ- এসবও কি যুদ্ধ নয়? যদি অটোমান-ভেনেশিয়ানদের যুদ্ধ মূল‍্যবোধের বিপর্যয় ঘটিয়ে থাকে, যেখানে মানুষ আস্তে আস্তে শিকারি হয়ে ওঠে বুনো জন্তুর মতো, তাহলে এই বিশ্বজোড়া অরাজক রক্তপাতের মধ্যে তা আর কোনও 'অ্যাবসোলিউট ইভেন্ট' হয়ে থাকে না, রোজনামচা হয়ে ওঠে।

'ওথেলো' নাট‍্যজুড়ে ইয়াগো বারবার নানা পশুর প্রসঙ্গ আনে। 'অথৈ'-এর ইয়াগো, ওরফে গোগো, ওরফে অনগ্র চ‍্যাটার্জি একজায়গায় অথৈ সম্পর্কে বলে, 'এখন ওর জীবন থেকে সমস্ত আদর্শ ভ‍্যানিশ, এবার ওর ভেতরের পশুটা বেরবে, যাকে কেউ দেখেনি।' মুরিশ ও কালো ওথেলোকে কখনও বর্বর ঘোড়া, কখনও নুলো দানো বলে অভিহিত করে ইয়াগো। এখানে অথৈ-এর পশু আসলে কি দীর্ঘলালিত বর্ণবাদী সংস্কারের ফসল? তাই অথৈ-এর শরীরের লোম দেখে বাচ্চারা ভয় পাবে, এমন মোটিফ-ও তৈরি হয়? স্মর্তব্য, 'ওমকারা'-য় চিলের মোটিফ ব‍্যবহার করেছিলেন বিশাল, ওমেন বা অশুভ চিহ্ন হিসেবে। কিন্তু সত্যিই কি এতটা পশু হয়ে উঠতে পারে মানুষ, যেখানে তার সুপার ইগো-র ভূমিকাই লুপ্ত হবে? গোগো কি আসলে জঙ্গলের রাজত্বে ধূর্ত হায়নার মতো? অনির্বাণ ভট্টাচার্য যে আশ্চর্য অভিনয় করেছেন 'অথৈ' চলচ্চিত্রে, তার মধ্যে ফিরে ফিরে আসা ফেউ ডাকার আওয়াজ তাই কি কানে লেগে থাকে?

কিন্তু ডেসডিমোনা? এখানে যে দিয়ামনা, দিয়া? সে কী করবে? এই পশুর রাজত্বে, মানুষকে পশু বানানোর রাজত্বে একা মানুষ হয়ে থেকে যাওয়ার দায় তার? না, তার একার নয়। এমিলিয়া, ওরফে মিলি; বিয়াঙ্কা, ওরফে পিঙ্কি-রও। অথবা অথৈ-এর না-দেখা দিদা, কেবল আগুনে পুড়তে যাকে দেখা গেছে, অথবা তার স্নেহময়, ছাইয়ের মধ্যে থেকে উঠে আসা আলোর মতো মা, অথবা গোগো-র মা, যে কেবলই গেরস্থালির ভেতর দৃশ্যমান, তারাও তো আসলে মানুষী আবহের ভার বহন করে চলে। প্রতারিত হয়ে, মিথ্যে সন্দেহের বিষে নীল হয়ে, বাধ‍্যত প্রবঞ্চনা করে, কখনও কেবলই জাতের জন্য, লিঙ্গরাজনীতির জন্য সব দিয়েও শূন্য হাতে তাদের ফিরতে হয়। বাদবাকি খেলায় কেউ হারে, কেউ জেতে, কেউ হয় বোড়ে, ঘোড়া, গজ, নৌকো।

অ্যাক্ট বা অঙ্কভাগকে ক্রিকেটের পরিভাষায় নিয়ে এসেছেন অর্ণ মুখোপাধ্যায়। ক্রিকেট না-দেখা দর্শকের কাছে সেই পরিভাষাগুলি হয়তো থাকবে আখ‍্যানের অংশ হয়েই। কিন্তু গল্পের চলনে প্রথমেই একটি বিচ‍্যুুতি তৈরি হয়। গোগো-র সলিলকি বা স্বগতোক্তি এখানে চতুর্থ দেওয়াল ভেঙে ক‍্যামেরার মুখোমুখি হয়। প্রথমেই ক‍্যামেরা তাকে পেরিয়ে যাওয়ার সময় গোগো বলে, 'ইউ নিড টু শো মাই ফেস বাডি।' এবং পরমুহূর্ত থেকেই ক‍্যামেরা ও দর্শকের চোখ গোগো-র বশংবদ। দৃশ্যের এগনো, পিছনো, বিরতি- সেই-ই নিয়ন্ত্রক। তাই একরকম আয়নায় আমরা দেখতে থাকি নিজেদের বিষগুলোকে। অথৈ আর গোগো যৌন বাসনার বশ। অথৈ-কে ভিনসুরার যৌন রোগের পোস্টার ফেস বলা থেকে বারবার মূত্রত্যাগের চিহ্ন ব‍্যবহার, বা সংলাপে, ভঙ্গিতে, কখনও মন্টুর (মন্টানা ও ক্লাউনের সংশ্লেষ) আত্মমৈথুনে যে রগরগে স্বাদ লেগে থাকে, তা আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে লাল আলোয় মোড়া যৌন আকাঙ্ক্ষা ও সন্দেহে। ক‍্যাসিও ওরফে মুকুল একইসঙ্গে কিঞ্চিৎ বিদূষক হয়েও এই সন্দেহের বীজতলায় থেকে যায়।


গোগো ক‍্যান্সার রিসার্চ করে বিদেশে, তার মা ক‍্যান্সারের শেষ পর্যায়ে চিকিৎসা না পেয়ে চলে গিয়েছিল। অথৈ চায় গ্রামে স্বাস্থ‍্যকেন্দ্র বানাতে। ভিনসুরা গ্রামে স্বাস্থ্যসচেতনতা নিয়ে আসতে চায় এই দুই বর্ণ-অবস্থানের, এক কুলীন ও এক দলিত, শহুরে শিক্ষার সূত্রে। 'পুতুলনাচের ইতিকথা'-র শশী যেভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় গ্রামের থেকে, অথৈ, দিয়া ও গোগো-ও একইভাবে বিচ্ছিন্ন। তাই ভিনসুরা হয়ে থাকে এই ত্রিকোণের নখদাঁত, শদন্ত হিংসা ও বেইমানির মঞ্চমাত্র। তাই সিনে-বাস্তবতার নিরিখে কোনওকিছুই চেনা লাগছে না এই গ্রামের। এই ভিনসুরা ঘিরে অথৈ-এর আদর্শের সমান্তরালে কোথাও সুপ্ত রয়েছে প্রতিহিংসাও, যেজন্য যৌন বিশ্বাসঘাতকতার ধাক্কাতেও দিয়ার পদবি তার মনে উসকে ওঠে, ধিকিধিকি। আবার সে এই গ্রামকে নিজের বলে দাবি করে যে অধিকারে, তা কোথাও তার পুরুষকারের সঙ্গে মিশে যায়। কিন্তু সেই আদর্শের দাম আদৌ আছে ভিনসুরার মানুষের কাছে? তারা সেই আদর্শের কথা শুনতে শুনতে রিল দেখে, আচমকা আইটেম ড‍্যান্সে মেতে ওঠে। কোন ভিনসুরার দখল চায় গোগো আর অথৈ? তা কি আদতে গ্রাম, না গ্রামের ভূত? দু'জন জীবন্ত মানুষ আদতে কি কাকতাড়ুয়া হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক বিস্তীর্ণ শ্মশানে? যেখানে মৃতের ভিড়ে তারা খুঁজে চলে নিজেদের?

 

অনির্বাণ ভট্টাচার্য এই ছবির সৃজনশীল পরিচালক। ভৌতিকতার দৃশ্য ও শব্দ এই ছবিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে যতবার, ততবার যেন উঁকি মেরেছেন মাইক ফ্ল‍্যানাগান। উঁকি মারা, লক্ষ রাখা, ভয়‍্যার হয়ে ওঠা থেকে মৃত‍্যু ও হত‍্যার বিভিন্ন ইমেজ নির্মাণ ও শব্দের ব‍্যবহার, শুভদীপ গুহর নেপথ্য সংগীত, শুরু ও শেষে তিতাস ভ্রমর সেনের কণ্ঠে 'বদ হাওয়া লেগে খাঁচায়'-এর ব‍্যবহার অশরীরী হয়ে ওঠে। অনির্বাণ ভট্টাচার্যর অভিনয় শিরশিরে হয়ে ওঠে ক্রমশ, তাঁর ক্লোজ আপ থেকে শুরু করে সংলাপের ভঙ্গি, ক‍্যামেরার ওপর লিখে দেওয়া লাল কালির 'ও' (প্রসঙ্গত, এই নামেই ওথেলোর একটি চলচ্চিত্রায়ন ঘটেছিল)- সবক'টিতেই এক পর্যায়ে অস্বস্তি হতে থাকে। এই একই অস্বস্তি দিতে থাকেন সোহিনী সরকার। তাঁর চরিত্রের পরিণতিই যেন তাঁর প্রতিটি তাকানো, প্রতিটি চিৎকার, কান্নাকে আরও তীব্র করে তোলে? তা কি করুণ রস কেবল? না কি দিয়ার সঙ্গে আমরা আসলে নিজেদের জুড়ে নিই? সোহিনীর অভিনয়ই সেই পরিসর তৈরি করে? অর্ণর অভিনয়ে অথৈ-কে আমরা আর এক পর্যায়ের পর চিনতে পারি না বলেই এই ভয় আসলে? না কি গোগো আর অথৈকে আদতে আমরা নিজেদের মধ্যে খুঁজে পেয়ে যাই? সামান্য পরিসরে চমক দিয়ে যান দিতিপ্রিয়া রায়, বোঝা যায়, তিনি কতটা সম্ভাবনাময়। ভাল লাগে অর্পণ ঘোষাল, মিমি দত্তকে। কৌশিক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের উপস্থিতি দর্শককে প্রলেপ দেবে কিছুটা।

থিয়েটার ও সিনেমার চিরপরিচিত তর্ক আবারও উঠবে এই সিনেমা প্রসঙ্গে। কিন্তু সেই চর্চার বাইরেও একটা পরিসর থাকে। অথৈ এখানে গোগোর শত্রু, ভেবে দেখলে ইয়াগো ঈর্ষান্বিত আদতে হয়েছিল ক‍্যাসিওর প্রতি। সেই ঈর্ষা থেকেই ওথেলোর প্রতি তার যাবতীয় চক্রান্তের সূত্রপাত। এই ছবিতে অথৈ আর গোগো-ই প্রতিদ্বন্দ্বী। সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা কি এক উচ্চবর্ণ আর নিম্নবর্ণর? না কি দুই পুরুষ বন্ধুর? ফার্স্ট আর সেকেন্ডের? এই দ্বন্দ্বের আখ‍্যান এই ছবিতে নাটকের যাবতীয় সূত্র ব‍্যবহার করেও দিনের শেষে সিনেম‍্যাটিক‌। ভিস‍্যুয়ালই এই ছবিকে দিনের শেষে জীবন্ত করে তোলে। বাস্তবতার চেয়েও আরও বাস্তব তা নয় কি?

[আরও পড়ুন: ‘১২ বছরের অপেক্ষা…’, শিবপ্রসাদের পোস্টে ‘বহুরূপী’ নিয়ে আবেগঘন বার্তা]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • ভৌতিকতার দৃশ্য ও শব্দ এই ছবিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে যতবার, ততবার যেন উঁকি মেরেছেন মাইক ফ্ল‍্যানাগান।
  • ক‍্যাসিও ওরফে মুকুল একইসঙ্গে কিঞ্চিৎ বিদূষক হয়েও এই সন্দেহের বীজতলায় থেকে যায়।
Advertisement