সন্দীপ্তা ভঞ্জ: গোটা দেশে যখন নির্বাচনী আবহ। ভোট রাজনীতিতে তপ্ত কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, তখন পঞ্চায়েত রাজনীতির রণকৌশল নিয়ে ওয়েব প্ল্যাটফর্মে হাজির 'পঞ্চায়েত ৩' (Panchayat 3)। আগের দুই মরশুমে যেভাবে দর্শকদের নাড়ির স্পন্দন বুঝে ওটিটির পর্দায় গ্রামের তৃণমূল স্তরের রাজনীতির বাস্তব দলিল ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল, এবার কিন্তু সেই গল্পই নয়া মোড় নিল! ফুলেরা গ্রামের সচিবজি, প্রধানজি থেকে সহকারী বিকাশ কিংবা উপপ্রধান প্রহ্লাদচা... প্রত্যেকের চরিত্রই এতটা সাবলীল যে, সকলেই যেন আমজনতার একেকজন প্রতিনিধি।
'পঞ্চায়েত'-এর তৃতীয় মরশুমের মতোই ফুলেরা গ্রাম এবার আরও পরিণত। পূর্ব ফুলেরা ধুঁকলেও পশ্চিম প্রান্তে পাকা ঘরবাড়ির ভিড়। তবে ইলেকট্রিক এলেও কিংবা সিসিটিভি লাগানো গেলেও গ্রামের রাস্তা এখনও সারাই করা সম্ভব হয়নি। আর সেটাই পরবর্তী পঞ্চায়েত ভোটের আগে 'মুদ্দা' হিসেবে বিরোধীদের ষড়যন্ত্রের মূল উপাদান। যার নেতৃত্বে 'বনরাকস' ওরফে ভূষণ। বরাবরই এই সিরিজ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষগুলোর কথা বলে এসেছে। একটা গ্রাম পঞ্চায়েতে সেখানকার প্রধান, বিধায়ক, জেলাশাসকের কী ভূমিকা? কিংবা সরকারি সিস্টেমের স্তরগুলোয় কাজের যে গাফিলতি বা শান্তির সহাবস্থানের জন্য যে কৌশল প্রয়োগ করা হয়, সেটা এই সিরিজের ছত্রে ছত্রে গেঁথে দেওয়া হয়েছে। পেটের টান-সংসারের অভাব কীভাবে নাতি-ঠাকুমার সম্পর্ককেও যাঁতাকলে পিষে দেয়, দেখাল দীপক কুমার মিশ্র পরিচালিত 'পঞ্চায়েত ৩'। দ্বিতীয় মরশুমের মতো এবারও এই সিরিজ যেমন দর্শকদের হাসালো, রোমান্সের সুড়সুড়ি দিল, তেমন চোখের কোণও ভেজালো। এত সহজ-সরল, সুন্দর স্টোরি টেলিংয়ের জন্য চন্দন কুমারের হাততালি প্রাপ্য।
গ্রাম পঞ্চায়েতের 'কূটকচালি'র রাজনীতি কিংবা 'ভাতে নয় পাতে মারব' গোছের রাজনৈতিক ধ্যানধারণা যেভাবে চিত্রনাট্যে সাজানো হয়েছে এই তৃতীয় মরশুমে, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। বিশেষ করে আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটের কথা মাথায় রেখে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা প্রকল্পে নাম তোলার জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে যে ষড়যন্ত্র চলে, সিরিজে সেই কাহিনিও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। গ্রামীণ জীবনের আস্ত একটা পাঠ 'পঞ্চায়েত ৩'। যেখানে শহুরে সচিবজি অভিষেক ত্রিপাঠীর বদলি আটকানোর জন্য একজোট হয় পঞ্চায়েত প্রধান এবং তাঁর সহায়করা। তবে তৃতীয় মরশুমের (Panchayat season 3) শো স্টপার 'প্রহ্লাদচা'। এক সন্তানহারা পিতার হাহাকার আর তার সমান্তরালে গ্রামের উপপ্রধান হিসেবে দায়িত্ববোধের বোঝা যে একাই কাঁধে বয়ে নিয়ে যায়। বিকাশ যেন তাঁরই সারথী হিসেবে সিরিজের গল্প এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে।
[আরও পড়ুন: হুইলচেয়ারে মা, সকালে ভোট দিলেন রাজ-শুভশ্রী, গণতন্ত্রের উৎসবে শামিল কোয়েল-নুসরতরা]
জীতেন্দ্র কুমার, রঘুবীর যাদব, নীনা গুপ্তা, চন্দন রায়, ফয়জল মালিকদের মতো সিরিজের স্টার কাস্টই 'পঞ্চায়েত ৩' সিরিজের মূল ইউএসপি। কর্মজীবনের আকাঙ্ক্ষা এবং গ্রামীণ রাজনীতিতে জড়িয়ে সচিবজি অভিষেক ওরফে জীতেন্দ্রর চরিত্র এবারের মরশুমে অনেক পরিণত। রঘুবীর যাদবের অভিনয় দক্ষতা নিয়ে এই পরিসরে আর আলাদা করে বলার প্রয়োজন হয় না। পাকা অভিনেতা। টিপিক্যাল পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণা আর মেজাজ নিয়েও 'গৃহমন্ত্রী' মঞ্জুদেবী ওরফে নীনা গুপ্তার দাপুটে মতামত নিয়ে যেভাবে সংসারে শান্তির সহাবস্থান দেখিয়েছেন, তাতে রঘুবীরের চরিত্র যেন এই আম-সমাজের একজন বাস্তব প্রতিনিধি। ডিগ্ল্যাম চরিত্রে নীনার উপস্থিতি আগের দুবারের মতো এবারেও দর্শকদের মোহিত করেছে। রিঙ্কির সঙ্গে সচিবজির মিষ্টি মন আদান-প্রদানও নজর কাড়ল। যে প্রেমে কোনও কামগন্ধ নেই। আছে শুধুই অনুভূতি, বুক দুরু-দুরু!
রাজনীতি, ষড়যন্ত্র, সরকারি প্রকল্পের জন্য মারামারি... যাবতীয় উপকরণে তৃতীয় মরশুম সফল। রক্তের স্রোত না দেখিয়েও যে গুরুগম্ভীর রাজনৈতিক ইস্যু ফুটিয়ে তোলা যায় কমেডি কিংবা সারল্যের মোড়কে, তা প্রমাণ করলেন পরিচালক দীপক কুমার মিশ্র। প্লাস পয়েন্টের দিকে এই সিরিজের পাল্লা ভারী হলেও শেষপাতে উল্লেখ্য, ক্লাইম্যাক্স কিন্তু মোটেই ততটা জমেনি। সচিবজির মারপিটের দৃশ্য আরেকটু পোক্ত হলে মন্দ হত না। কারণ সেই সিকোয়েন্স 'পঞ্চায়েত'-এর চতুর্থ মরশুম নিয়ে আসার গুরুভার বহন করছে।