বিশ্বদীপ দে: গথাম শহরের আর্থার ফ্লেক ও কলকাতার ইকলাখ আলমের মধ্যে মিল কোথায়? এই দুই ভিন্ন পৃথিবীর মানুষের মধ্যে একটাই মিল। তারা বুঝে উঠতে পারে না 'হোয়াই এভরিওয়ান ইজ সো রুড।' এই অসহায়তা থেকেই আর্থার একের পর এক খুন করে। আর ইকলাখ অপহরণ করে এক ছোট্ট স্কুলছাত্রীকে। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের 'টেক্কা'(Tekka) দেখতে দেখতে এই কথাটা মাথায় খেলে যেতে পারে অনেকেরই। কেননা গত সপ্তাহেই মুক্তি পেয়েছে ‘জোকার: ফোলি আ দ্যু’। চরিত্রগত ভাবে সম্পূর্ণভাবে আলাদা হলেও আদারাইজেশনের শিকার মানুষ কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, সেটা কোনও এক সোনালি রেখায় মিলিয়ে দেয় কাছাকাছি সময়ে মুক্তি পাওয়া দুই ছবিকে। জোকারের দ্বিতীয় পর্ব তেমন জমেনি। কিন্তু পঞ্চমীর দিনে মুক্তি পাওয়া সৃজিতের পুজোর ছবি শেষপর্যন্ত কেমন হল?
ট্রেলার থেকে সকলেই জানেন, এটি একটি হস্টেজ থ্রিলার। দেব অভিনীত ইকলাখ চরিত্রটি অপহরণ করেছে ইরার (স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়) মেয়ে অবন্তিকাকে। স্কুল থেকে ফেরার সময় তাকে তুলে নিয়ে সেক্টর ফাইভের এক অফিসে নিয়ে আসে সে। তার পর বহুতলটির দশম তলায় লুকিয়ে পড়ে। মেয়েটিকে উদ্ধার করার দায়িত্ব পায় এসিপি মায়া খাস্তগীর। অভিনয়ে রুক্মিনী মৈত্র। ধীরে ধীরে সে জানতে পারে অন্য অপহরণকারীদের মতো ইকলাখ টাকাপয়সা কিছু চায় না। সে কেবল ফেরত চায় তার হারানো চাকরিটা। তার অফিস ছিল এই বাড়িতেই। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগে একমুহূর্তে বরখাস্ত হওয়ার জ্বালায় পাগল হয়ে পরদিনই সে হয়ে ওঠে হিংস্র অপহরণকারী। যে অপহরণকারী একটা ছোট্ট মেয়ের কপালে বন্দুক ঠেকাতে পারে অনায়াসে। যে বিশ্বাস করে সমাজে গরিব হয়ে জন্মানো একটা অপরাধ। ধর্মীয় সংখ্যালঘু হয়ে জন্মানোটাও! তার চোখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সমাজের বিত্তবান শ্রেণির কাছে দরিদ্রের কার্যতই কোনও অস্তিত্ব নেই। তারা তাদের মুখটুকুও মনে রাখতে পারে না। অভিমান আর ক্রোধ মিলেমিশে তৈরি করেছে ইকলাখের এই অপরাধপ্রবণতা। এদিকে ট্রেলার থেকে সকলেই জানেন, পালটা ইকলাখের ছেলেকেও কিডন্যাপ করবে ইরা। আর তার পরই ছবি আরও জমজমাট হয়ে ওঠে। শেষপর্যন্ত কে কাকে টেক্কা দেবে? সেই 'খেলা'য় মায়ার ভূমিকাই বা কী হবে? এই প্রশ্নগুলিকে সামনে রেখেই এগিয়েছে ছবির গল্প। যদিও শেষে রয়েছে এক দুরন্ত চমক। যা আগের অনেক হিসেব নিকেশই ওলট পালট করে দেয়।
সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ছবি মানেই দারুণ গান। এই ছবিও তার ব্যতিক্রম নয়। কবীর সুমনের গানটি চমৎকার এক মাত্রা শুরুতেই যোগ করে দেয়। বাকি দুটি গানই দ্বিতীয়ার্ধে। কেবল যে শ্রুতিমধুর তাই নয়, একেবারে সুপ্রযুক্ত। থ্রিলার বলেই এর বেশি গান ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত একেবারে সঠিক প্রতিপন্ন হতে থাকে। ছবিটিতে একটা টানটান ভাব আগাগোড়াই বজায় থাকে। যদিও দ্বিতীয়ার্ধের একটা সময় যেন কিছুটা শ্লথ হয় ছবিটি। কিন্তু তার পরই রয়েছে দুর্দান্ত ক্লাইম্যাক্স। আলাদা করে বলা উচিত ছবির আবহসঙ্গীতের কথাও। বন্দুক হাতে শূন্য অফিসে গুঁড়ি মেরে এগোচ্ছে মায়া, সেই সময় যে আবহ তা দৃশ্যটিকে যেন একটি অন্য উচ্চতায় তুলে নিয়ে যায়। এরকম উদাহরণ আরও রয়েছে।
এই ছবিতে রুক্মিনী মৈত্রর চরিত্রটি অসাধারণ। আইভিএফের মাধ্যমে অন্তঃসত্ত্বা হতে শরীরে ইনজেকশন গ্রহণ করে ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতেও মায়া নিজের 'ডিউটি' করে যায়। ছোট চুলে রীতিমতো 'রাফ অ্যান্ড টাফ' লুকে রুক্মিনী বাজিমাত করেছেন। অন্যদিকে স্বস্তিকার অসহায় আর্তি, রাগ মেশানো অভিনয়ও অনবদ্য। মেয়ের অপহরণের খবর পেয়ে ছটফট করতে থাকা ইরার মধ্যে ফুটে ওঠে চিরকালীন মাতৃমূর্তির জলছাপ। একটি দৃশ্যে তাকে বলতে শোনা যায়, ''আমি একজন মা। ব্যাস। ফুলস্টপ।''
এদিকে ছবির খল চরিত্রে পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় চমকে দিয়েছেন। সাধারণ ভাবে মজার চরিত্রে কিংবা চরিত্রাভিনেতা হিসেবে তাঁকে দেখতে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু অনুব্রত অধিকারীর ক্রুরতা তিনি যেভাবে ফুটিয়েছেন তা অনবদ্য। একটি দৃশ্যে ক্লোজ আপে স্রেফ চোখের অভিব্যক্তিতেই তিনি হাড়হিম এক মুহূর্ত তৈরি করে দেন। টোটা কিংবা কমলেশ্বর, সৃজা দত্তরা তাঁদের অভিনয়ে যথাযথ।
এবং দেব। এই ছবির নিউক্লিয়াস কিন্তু তিনিই। সৃজিত মুখোপাধ্যায় তাঁকে যেভাবে ব্যবহার করেছেন সেটা অসাধারণ। এই দেবকে বোধহয় টলিপাড়া এর আগে দেখেনি। একমুখ দাড়ি, এলোমেলো চুল- রাগে গরগর আকলাখ যখন শান্ত হয়ে যায়, সেই সময় মুখের পেশির বদল ঘটিয়েই চরিত্রটিকে অন্য ডায়মেনশনে নিয়ে যান দেব। একদা 'চকোলেট বয়' দেব অধিকারী যে কতটা পরিণত হয়ে উঠেছেন তা ছবির পরতে পরতে স্পষ্ট হয়ে যায়।
তবে এই ছবির একটি ফ্যাক্টর যদি দেব হন, তাহলে অন্যজন সৃজিত মুখোপাধ্যায়। টানটান চিত্রনাট্যের এই থ্রিলার কখনওই নিজের ট্র্যাক থেকে সরে আসে না। এই কৃতিত্ব একান্তভাবেই পরিচালকের। পুজোয় তিনটি বাংলা ছবির কে কাকে টেক্কা দেবে বক্স অফিসে, সেটা সময় বলবে। তবে একথা বলাই যায়, সৃজিত-দেবের যুগলবন্দির রেশ কিন্তু মনে থেকে যাওয়ার মতোই।