বিতান চক্রবর্তী: ঢাউস কালো লোহার কড়াইটা নামানো হত ভাদ্র কাটলেই। পুরো ভাদ্রে ধান শুকিয়েছে ছাদে। সকালে স্কুল থেকে ফিরে এসে সারা দুপুর চিলেকোঠায় বসে পাহারা দিতাম ধান। বৃষ্টি এলে শুকোতে দেওয়া ধানের ডালা তুলে আনতে হবে। ডালার ওপর গামছার ঢাকনা থাকলেও, অতিথির অভাব হত না। শালিখ, বুলবুলি, কাঠবেড়ালি পাহারাদারের চোখ এড়িয়ে ঠুকরে খেত ধান। বৃষ্টি আসত বর্গীদের মতো। ছুটে যেতে যেতেই ভিজিয়ে দিত খাজনা।
ছেলেমানুষ, হাতে জোর নেই তেমন। ছায়াতে আনতে আনতে টলমল হাত থেকে ছিটকে পড়ত ধান। কুড়িয়ে নিতাম বকা খাওয়ার ভয়ে। আর যে-কটা ধান আমার নরম আঙুলে উঠত না, তার দোষ পাখিদের ঘাড়ে চাপিয়ে রেহাই পেতাম। ধান শুকোলেই কড়াই পাড়া হত। বাথরুমের ছাদ খানিক খাটো করে, তার ওপর বানানো হয়েছিল ভাঁড়ার ঘর।
সেখানেই বছরভর রাখা থাকত কড়াইখানা। মই লাগিয়ে উঠতে হত। আমরাই উঠতাম। কারণ বাচ্চারাই সে-ঘরে চলতে পারে হামাগুড়ি দিয়ে। পরিষ্কার উনুন। নতুন মাটি পড়েছে। ঘুঁটে, কয়লা, গুলে আঁচ সাজানো হত। ওদিকে পাড়ার দোকান থেকে সাদা বালি নিয়ে এসেছেন ঠাকুমা। মা শুকনো নারকেল পাতার শিরা ছাড়িয়ে বানিয়েছেন ঝাঁটা।
আশ্বিনে ভাজা শুরু হল খই। এ-খই চলবে সেই কালীপুজো পর্যন্ত। খানিকটা খই রাখা থাকবে ঠাম্মার প্রতিদিনের আহার্য হিসেবে। ব্রাহ্মণের বিধবা, চালের চিঁড়ে-মুড়ি খাওয়া নিষেধ। বাকি খইখেজুরের গুড় দিয়ে বানানো হবে মোয়া আর মুড়কি। শীতকাল পর্যন্ত সেই ছিল আমাদের পুরস্কারমূল্য। যে কোনো ভালো কাজ করলেই সন্ধ্যায় হাতে আসত ঠাম্মার গুপ্তধনের পাত্র থেকে একখানা মোয়া।
পুড়ে যাওয়া কালো বালিতে ঝাঁটার নাড়ে সোনালি ধান ফুটে বেরিয়ে আসত ধবধবে খই। খইভাজার স্বর্গীয় গন্ধ কেউ কোনওদিন পারফিউম বানানোর কাজে ব্যবহারের কথা কেন ভাবেনি কে জানে! ভাঙা হাতেই ঠাম্মা চেলে নিতেন খই। নীচের থালায় এসে জমত, আধভাজা, না-ভাজা খইয়ের দানা। ওপরের বিশুদ্ধ খই চলে যেত বড়ো টিনের বাক্সে।
নীচের বাতিল খইও রাখা হত এক চায়নাবোনের পাত্রে। ও-খই চিবিয়ে খাওয়ার ক্ষমতা ঠাম্মার ছিল না। দুধেও নরম হত না। শেষে মা তাতেই কাঁচা লঙ্কা কুচি, বেসন, নুন আর সামান্য জল ছিটিয়ে মেখে নিতেন। খানিক মজে এলে কড়াতে তেতে যাওয়া তেলের থেকে দু-চামচ গরম তেল ওই মাখাতে ছড়িয়ে আবারও মেখে নিতেন। ডান হাতের আঙুলের চাপে চ্যাপ্টা মণ্ড চলে যেত গরম তেলে। ষষ্ঠীতে পাতলা মুগের ডালের পাতে পড়ত গরম গরম খইয়ের বড়া।