শাঁওলি দে: দুর্গাপূজা মানেই মায়ের হাত ধরে আমাদের দুই বোনের দিদার বাড়ি চলে যাওয়া। সতেরো বছর আগে হারিয়ে যাওয়া দিদার হাতের রান্না আজও মুখে লেগে আছে। ইলিশ কিংবা পাঁঠার মাংস নয়, ছোট মাছের চচ্চড়ি। মাটির উনুনের পাশে সব উপকরণ পর পর সাজানো। একটা বড় থালায় মশলা বেটে রাখা, আর একটায় ঠিক মাছগুলোর সাইজে সবজি কেটে রাখা। মাছ বলতে মৌরলা, ট্যাংরা আর আমাদের উত্তরবঙ্গের সুস্বাদু বোরোলি।
দিদা বলত, মাছ যে মাপের হবে, সবজিও ঠিক সেই মাপের লম্বা লম্বা করে কাটতে হবে। আলু, মুলো, ঝিঙে, পটল, বেগুন, গাজর আর পেঁয়াজ। পটলের বীজগুলো পেট চিড়ে বের করা যাতে খাওয়ার সময় অবাঞ্ছিত কিছু মুখে না পড়ে। আদা আর কিছুটা পেঁয়াজ মিহি করে বাটা। সবুজ লঙ্কাও আছে বেশ কয়েকটা। দিদা বলত, শুকনো লঙ্কার চাইতে কাঁচা লঙ্কা রান্নায় দিলে রং খোলে ভালো। বাটির মধ্যে জিরে ও ধনে বেটে রাখা। গুঁড়ো মশলা নয়, কড়াই গরম করে তাতে গোটা জিরে ও ধনে লাল করে ভেজে তা সাবেকি শিলনোড়ায় বাটা।
কড়াইতে প্রয়োজনমতো সর্ষের তেল দিয়ে তা গরম করে নিয়ে দিদা খুন্তি দিয়ে নেড়ে দেখে নিত তেলে কোনও ফেনা তৈরি হয়েছে কিনা! ফেনা আছে অর্থাৎ তেল তেমন গরম হয়নি এখনও। তেল পর্যাপ্ত গরম হলে তাতে এক মুঠো মাছ তুলে ছেড়ে দিত। চিটপিট শব্দ করে মাছগুলো ভাজা হয়ে যাচ্ছে। চচ্চড়ির জন্য দিদাকে লাল করেই মাছ ভাজতে দেখেছি।
দু-তিনবারে সব মাছ ভাজা হয়ে গেলে আলাদা করে তুলে রেখে লম্বা করে কাটা আলু ভাজার জন্য দিত দিদা। ছ্যাঁৎ করে একটা শব্দ হত। আলু লালচে করে ভাজা হয়ে গেলে, তা একটি পাত্রে তুলে রাখা হত। এবার একে একে পটল, মুলো, গাজর আর ঝিঙে দিয়ে দিত কড়াইতে। সামান্য ভাজা ভাজা হয়ে এলে ওতে বেগুন দিয়ে আবার ভাজা শুরু। ভাজা শেষ হলে সেগুলোও তুলে রাখা হত। এর পর পেঁয়াজের পালা, ওটাও ভাজতে ভাজতে বাদামি হয়ে এলে ওর মধ্যেই কালো জিরে ফোড়ন দিতে হবে। বাঁ হাতের তালুতে কালো জিরে নিয়ে একটু ঘষে নিত দিদা, তাতে গন্ধ ওঠে ভালো। পেঁয়াজ আর কালোজিরে ভালো ভাবে মিলেমিশে গেলে ওতে এক চুটকি চিনি দিত দিদা। বলত, ফোড়নের পরপর সামান্য চিনি দিলে তরকারির রং খুব ভালো হয়।
কালো জিরে ও পেঁয়াজের মাখামাখিতে একটা সুন্দর গন্ধ বের হত। এবার ওই ভেজে রাখা সবজি আর মাছ একসঙ্গে তেলে ছেড়ে দেওয়ার পালা। সামান্য নাড়াচাড়া করে বেটে রাখা আদা, জিরে, ধনে ও হলুদ দিয়ে বেশ মাখো মাখো করত দিদা। লাল হলুদ আর সবুজ মিলেমিশে একটা দারুণ বাহারি রং ধরত। ভালো করে কষাতে হবে এইবার। জল একফোঁটাও না, লবণ স্বাদমতো, কষানোর সময় ওর থেকেই জল উঠবে, সেদ্ধর জন্য আর জলের প্রয়োজন হবে না। এবারে কড়াইটা ঢেকে দিয়ে অপেক্ষা করত দিদা। রান্না হয়ে গেলে যখন আমরা অন্য সবকিছু সরিয়ে আরও একটু মাছ চচ্চড়ি চাইতাম, তখন দিদার মুখটা এত উজ্জ্বল হয়ে উঠত যে আরও তার ছটা আজও আমার চোখে লেগে আছে।