আকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়: সত্যি কথা বলছি। গ্রুপ লিগে মোহনবাগানের কাছে পাঁচ গোল খাওয়ার পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। শুধু আমি নই। পুরো দলটা। কারণ, মোহনবাগানের কাছে আমরা হারতে পারি। তবে পাঁচ গোল খাওয়ার মতো দল নই। কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না, পাঁচ গোল কীভাবে খেলাম। পুরো দলটা যখন হতাশায় জর্জরিত, এই সময় ফোন করল দাদা (অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়)। জরুরি নির্দেশ দিল, কোচ কিবু ভিকুনার হোটেলে কোচ-ফুটবলার এমনকী, আমাদের জুনিয়র দলের ফুটবলারদের নিয়ে একটা ডিনারের আয়োজন করতে।
রাজনৈতিক শিডিউলে যতই ব্যস্ত থাকুক না কেন, দাদা কিন্তু ডায়মন্ডহারবার নিয়ে প্রতিদিন খোঁজ নেবেই। মাঝে মধ্যেই কিবু ভিকুনার সঙ্গে ফোনে কথা বলে। খোঁজ নেয় দলের। আমরা যেবার আই লিগ তৃতীয় ডিভিশন চ্যাম্পিয়ন হলাম, আলিপুরের পাঁচতারা হোটেলে পার্টি দেওয়া হয়েছিল। দাদা এসে সব ফুটবলারদের উৎসাহিত করে। ফলে মোহনবাগানের কাছে পাঁচ গোল খাওয়াতে দাদা যে উদগ্রীব হয়ে উঠবে এরকমটাই আশা করেছিলাম। পরিকল্পনামতো ডিনারের আয়োজন হল। সেখানে দাদা একটা অডিও রেকর্ড পাঠিয়েছিল, যা শোনানো হয়েছিল কোচ আর সব ফুটবলারকে। নিজের জীবনের নানা ওঠাপড়ার উদাহরণ দিয়ে দাদা বলেছিল, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল, এরাও বিভিন্ন সময়ে বড় ব্যবধানে ম্যাচ হেরেছে। কিন্তু সেখান থেকে আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে ইতিহাস তৈরি করেছে। জীবনে যখন ব্যর্থতা আসবে, তখন সেই ব্যর্থতাকে শক্তির হাতিয়ার হিসাবে প্রস্তুত করতে হবে। তাই এই হারেই সব শেষ হয়ে যায়নি। আবার ঘুরে দাঁড়াতে হবে।
দাদার এই বার্তার পরই জামশেদপুর ম্যাচে পুরো ঘুরে যায় দলটা। আমরা এখন ফাইনালে। তাহলে কি আমাদের লড়াই শেষ হয়ে গেল? একদমই না। আজ সকালেই ফোন করেছিল দাদা। বলল, ফাইনালে উঠে থেমে গেলেই হবে না। শেষ লড়াইটাও জিততে হবে। আসলে ফুটবলকে ঘিরে দাদা, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্যাশনটা এরকমই। ২০১৭-র দিকে দাদা একদিন বলল, এই যে ডায়মন্ডহারবারের বিভিন্ন জায়গায় ফুটবল খেলার এত আগ্রহ, সবাইকে নিয়ে একটা বড় করে প্রতিযোগিতার আয়োজন করলে কেমন হয়? অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কিছু নিয়ে ভাববে, আর আমরা সেই ভাবনার যজ্ঞে নেমে পড়ব না, এরকমটা হয় না। সঙ্গে সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়ে গেল, কী করা যায়। ঠিক হল, ডায়মন্ডহারবারের সব ক্লাবকে নিয়ে হবে 'এমপি কাপ'। একটা কথা মাথায় রাখবেন, এই যে এখন চারিদিকে এমপি কাপ, এমএলএ কাপ হয়, দাদা শুরু করার আগে কিন্তু এসব ছিল না। আর প্রথম বছরেই এমপি কাপ সুপার ডুপার হিট। দেখা গেল এই প্রতিযোগিতা ঘিরে এলাকার মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ তৈরি হয়ে গিয়েছে। পরের বছর সবাই অপেক্ষা করে আছে, কবে হবে এমপি কাপ। যেন আমাদের একটা বাৎসরিক উৎসব। এমপি কাপ জেতার জন্য ডায়মন্ডহারবারের ক্লাবগুলি বছরের শুরু থেকে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ফাইনালে আমরা ফুটবলারদের বাইক পর্যন্ত দিয়েছি।
পর পর দু'বছর সফলভাবে এমপি কাপ হওয়ার পর দাদা একদিন বলল, ডায়মন্ডহারবারের মানুষের মধ্যে ফুটবল নিয়ে যখন এতটাই উৎসাহ, তখন ডায়মন্ডহারবারের নিজস্ব একটা ক্লাব করলে কেমন হয়? কিন্তু যে সময় আমরা ক্লাব খোলার কথা ভাবছিলাম, সেই সময়ই কোভিড চলে এল। ফলে পরিকল্পনা সব পিছিয়ে গেল। অবশেষে ২০২২-এর দিকে দাদা একদিন ডেকে বলল, আর দেরি করা চলবে না। এখনই ক্লাব খুলে এই মরশুম থেকে কলকাতা লিগে খেলতে হবে। সিদ্ধান্ত হল, আমাদের এলাকার ক্লাবের নাম হবে, ডায়মন্ডহারবার এফসি। শুরু থেকেই আমাদের ক্লাবের সঙ্গে ছিলেন প্রাক্তন ফুটবলার গৌরাঙ্গ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানস ভট্টাচার্যরা। প্রতিটি এমপি কাপের ফাইনালে ধারাভাষ্য দিতেন মানসদা। তাই ঠিক হয়েছিল, ক্লাবের শুরু থেকে এদেরকে জড়িয়ে নেওয়া হবে। সঙ্গে কাশীদা, অরিজিৎ সমাজপতি, রাতুল সবাই। আইএফএর সঙ্গে কথা বলে দ্রুত প্রথম ডিভিশনে অ্যাফিলিয়েশন নেওয়া হল।
কিন্তু আসল সমস্যা অন্য জায়গায়। দেখলাম, লিগে খেলার জন্য দল তৈরি করতে হবে মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে। এত কম সময়ের মধ্যে কীভাবে দল গড়ব? আবার বাজে দলও তৈরি করা যাবে না। দল তৈরি নিয়ে আলোকেশ কুণ্ডু আর নবাব ভট্টাচার্যর সঙ্গে দ্রুত আলোচনায় বসি। ময়দানের দল তৈরি নিয়ে আমাদের মধ্যে অরিজিৎ ছাড়া আর কারও অভিজ্ঞতা বা যোগাযোগ ছিল না। সবাই আমরা নতুন। নবাবদা বোঝাল, কীভাবে দল গড়তে হবে। যখন শুনল, আমরা সারা বছর দলটাকে হোটেলে রেখে প্র্যাকটিস করাব। সঙ্গে পেশাদার পথে চলতে চাই, তখন পরামর্শ দিল, এরকম হেভিওয়েট দলে একজন বিদেশি কোচ রাখলে ভালো হয়। এরপর ভারতে কোচিং করে যাওয়া চারজন কোচের নাম দিলেন। দেখলাম, এর মধ্যে কিবু ভিকুনার নাম রয়েছে। ব্যস, আমি আর অন্যদিকে তাকাইনি। তখনই ঠিক করে নিই কিবুকে কোচ করতেই হবে। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলাম, মোহনবাগানের দেবাশিস দত্তকে। অনুরোধ করলাম, আমাদের সঙ্গে কিবুর মিটিং করিয়ে দিতে। দেবাশিসদাই কিবুকে কল করে আমাদের দল সম্পর্কে ধারণা দেয়। আমাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দেয়। আমরা শুরুতে একটা সংশয়ে ছিলাম, একজন আই লিগ জয়ী কোচ শেষ পর্যন্ত প্রথম ডিভিশনের একটা নতুন দলের কোচ হবেন তো? প্রায় মাসখানেক আমাদের সঙ্গে কিবুর ভিডিও কনফারেন্সে কথা হত। অবশেষে আমাদের কোচিং করাতে রাজি হলেন।
প্রথম বছরেই লিগে আমাদের গ্রুপে রানার্স। প্রথম বছরে অল্পের জন্য আই লিগের তৃতীয় ডিভিশনে চ্যাম্পিয়ন হওয়াটাও আমরা ফস্কালাম। এরপর পর পর দু'বছর আই লিগের তৃতীয় ডিভিশন, দ্বিতীয় ডিভিশন চ্যাম্পিয়ন হয়ে আমরা আই লিগে। এবার লক্ষ্য আই লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়া। আমাদের মাথার উপর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সব সময় আমাদের স্বাধীনভাবে ক্লাব চালানোর স্বাধীনতা দিয়েছেন। সেরকম আমরাও আমাদের কোচকে সব সময় স্বাধীনতা দিয়েছি। দলের ব্যাপারে শেষ কথা বলবেন কিবু ভিকুনা। আজকে নয়। যাই ফলাফল হোক, প্রথম ডিভিশন থেকে আমরা দলটাকে পেশাদার ভাবে চালাচ্ছি। প্রথম বছরেই সারা শহর জুড়ে আমরা ডায়মন্ডহারবার এফসি-র ব্র্যান্ডিং করেছি। ফলাফল অন্যরকম হতেই পারে। কিন্তু অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের শিখিয়েছেন, নিজেদের সেরাটা দিতে হবে। মাঠের ভিতর কোচ-ফুটবলাররা দেন। মাঠের বাইরে আমরা। তাই চার বছরের ডায়মন্ডহারবার এফসি আজ দুই বড় দলকে টপকে ডুরান্ডের ফাইনালে। তবে এখন আর আমরা শুধুই ডায়মন্ডহারবার এফসি নই। আমরা বাংলার প্রতিনিধি। আমাদের চ্যাম্পিয়ন হওয়া মানে, বাংলার ফুটবলের জয়। চাইছি, ফাইনালে সবাই যুবভারতী এসে আমাদের দলকে সমর্থন করুন। আমাদের ফুটবলারদের মনোবল বাড়ান।
