সোহম রায়, ফ্রাঙ্কফুর্ট: ইউনাইটেড বাই ফুটবল। ইউনাইটেড ইন দ্য হার্ট অফ ইউরোপ। এবারের ইউরো কাপে এটাই ‘মোটো’ উয়েফার। যেখানে ফুটবলের মাধম্যে সৌভ্রাতৃত্বের বার্তা, সম্প্রীতির বার্তা দেওয়া হচ্ছে। কাকতালীয় কি না জানি না। তবে একটু তলিয়ে ভাবলে এ হেন বার্তার সঙ্গে একটা বিষয়ের বেশ মিল পাওয়া যায়। বার্লিন দেওয়াল পতনের পর, পূর্ব ও পশ্চিম দুই জার্মানি একাত্ম হওয়ার পর, এই প্রথম ইউরো-মহাযজ্ঞ বসছে এ দেশে। আবার দেখুন, সেই টুর্নামেন্টের ‘মোটো’ হল– একতা।
আসলে এবারের ইউরো কাপ একটি ব্যতিক্রমী প্রেক্ষাপটে হচ্ছে জার্মানিতে। প্রথমত, ইউরোপীয় মহাদেশে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ এবং এ দেশে তার সূদূরপ্রসারী প্রভাব। দ্বিতীয়ত, শরণার্থীদের অভিবাসন নিয়ে নিত্যনতুন আভ্যন্তরীণ বিতর্ক। এবং শুধু যে রাজনীতিতেই এ জিনিস সীমাবদ্ধ ভাবার কারণ নেই। আশ্চর্যজনক ভাবে ফুটবলেও তার প্রবেশ ঘটেছে।
[আরও পড়ুন: বিশ্বকাপ অভিযান শেষ! চুক্তি জটিলতায় স্টিমাচের পদত্যাগের দিকে এখন তাকিয়ে ফেডারেশন]
গত এপ্রিল মাসে জার্মান পাবলিক ব্রডকাস্টার ‘ডব্লুডিআর’ একটা সমীক্ষা করে। সমীক্ষার দু’তিনটে বিষয় ছিল। এক) জার্মান ফুটবল টিমে আরও বেশি করে শ্বেতাঙ্গ ফুটবলার থাকা উচিত কি না? দুই) শরণার্থী ফুটবলার খেলিয়ে জার্মান ফুটবল টিমের লাভ হচ্ছে কি না? তিন) তুরস্ক-জাত ইকে গুন্দোগানকে জার্মান অধিনায়ক করা লজ্জাজনক কি না? মোট তেরেশো লোকের মধ্যে এই তিনটে সমীক্ষা চালানো হয়। কিন্তু একটাও আমল পায়নি। একুশ শতাংশ লোক রায় দিয়েছিলেন, জার্মান টিমে আরও বেশি শ্বেতাঙ্গ ফুটবলার দরকার। পঁয়ষট্টি শতাংশ যা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ছেষট্টি শতাংশ লোক রায় দিয়েছিলেন যে, শরণার্থী দেশের ফুটবলার খেলিয়ে লাভ হয়েছে জার্মানির। আর মাত্র সতেরো শতাংশ বলেছিলেন যে, তুরস্ক-জাত গুন্দোগানকে তাঁদের অধিনায়ক মেনে নিতে অসুবিধে আছে। রায় যা-ই হোক। অনেকেই আশ্চর্য হয়েছিলেন এ ধরনের সমীক্ষা বসতে দেখে। জার্মানি কোচ জুলিয়ান নাগেলসম্যান যে সমীক্ষাকে ‘বর্ণবিদ্বেষীমূলক’ বলতে দু’বার ভাবেননি! বরং বলে দেন, ‘‘আমার মতে, বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-সংস্কৃতিকে এককাট্টা করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে ফুটবল। রোলমডেলের কাজ করতে পারে।’’
যাক গে। এবার জার্মানির ইউরো আয়োজনে ফিরি। কর্মসূত্রে আমি ফ্রাঙ্কফুর্টের বাসিন্দা। এবং একদিক থেকে দেখলে, ইউরো কাপের সঙ্গে আমিও জড়িয়ে। আসলে গত বছর ইউরো কাপের স্বেচ্ছাসেবক হতে চেয়ে আবেদন করেছিলাম। ভিডিও ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। সে আবেদন মঞ্জুর হয়েছে। জার্মানির সরকার চায়, সাধারণ মানুষও ইউরো কাপ নামক ফুটবল-উৎসবের শরিক হোক। টুর্নামেন্টের সময় সমগ্র জার্মানি জুড়ে প্রায় ষোলো হাজার স্বেচ্ছাসেবক থাকছেন। ফ্রাঙ্কফুর্টেই রয়েছেন আমার মতো ষোলোশো জন। যাগ-যজ্ঞও চলছে পুরোদমে। ফ্রাঙ্কফুর্টের ট্রামে-ট্রেনে ইউরোর ছবি-ব্যানারে দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের শহরে ‘মাইন’ নামে একটা নদী আছে। সেই নদীর ধারে দেড় কিলোমিটার জায়গা ধরে ‘ফ্যান জোন’ তৈরি করা হচ্ছে। যেখানে প্রতিদিন প্রতিটা খেলা দেখানো হবে। তিরিশ হাজার লোক একসঙ্গে সেই ‘ফ্যান জোন’-এ খেলা দেখতে পারবেন। আবার ‘ফ্যান ওয়াক’ থাকছে। অর্থাৎ, যে রাস্তা দিয়ে বিভিন্ন দেশের সমর্থকরা হেঁটে যাবেন।
ফ্রাঙ্কফুর্টের ফ্লোসার ব্রিজে তো আজ রাত্তিরে একটা ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ শো-ও হয়ে গেল ইউরো কাপ নিয়ে।
অর্থাৎ, উপকরণ-আয়োজনে কোনও ফাঁকফোকর থাকছে না। থাকার কথাও নয়। ৩১ দিন ধরে ৫১-টা ম্যাচ হবে। দশটা স্টেডিয়াম জুড়ে চব্বিশটা টিম খেলবে। সাতাশ লক্ষ লোক সর্বমোট থাকতে চলেছেন বিভিন্ন স্টেডিয়াম জুড়ে। ‘ফ্যান জোন’-এই থাকবেন এক কোটি কুড়ি লক্ষের কাছাকাছি। ধরে রাখা হচ্ছে, টিভিতে ফাইনাল দেখবেন তিনশো মিলিয়ন লোক। যা আয়োজন দেখছি, তাতে আগামী এক মাস ধরে বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীরা যে অবিস্মরণীয় সমস্ত মুহূর্ত উপহার পেতে চলেছেন, সেটা লিখে দেওয়াই যায়।