সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: আমাদের খুঁজলে পাবে সোনায় লেখা ইতিহাসে…। শুধু গানের কলিতে নয়, গত এক দশকে মোহনবাগানের ইতিহাস বাস্তবেও সোনায় মোড়া। যেখানে ওঠানামা আছে, লড়াই আছে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আছে সাফল্য। শনিবার রাতের পর কোটি কোটি সবুজ-মেরুন সমর্থক যে সাফল্যের জয়গান গাইতে পারেন, যে সাফল্যের ইতিহাসে ভর করে বলতে পারেন, ‘আমরাই মোহনবাগান, আমরাই ভারতসেরা।’

শুধু কথার কথা নয়, এক দশকের ইতিহাস বলছে, মোহনগান এই মুহূর্তে সত্যিই ভারতের সেরা ক্লাব। গত ১০ বছর সবুজ-মেরুন তাঁবুতে যেমন ঢুকেছে দুটি আই লিগ, তেমনই ঢুকেছে দুটো আইএসএল লিগ শিল্ড এবং একটি আইএসএল কাপ। যেমন ঢুকেছে ফেড কাপ, তেমনই ঢুকেছে ডুরান্ডও। যেমন সাফল্য এসেছে কলকাতা লিগে, তেমনই সেরার শিরোপা এসেছে দেশের প্রথম সারির লিগেও।
এক দশক আগে মোহনবাগানের (Mohun Bagan) সাফল্যের গাঁথা শুরু হয় আই লিগে। ২০১৫-র ৩১ মে। বেঙ্গালুরুর কান্তিরাভায় সেদিন সাফল্যের নতুন সূর্যের উদয় দেখেছিল সবুজ-মেরুন জনতা। সুনীল ছেত্রীদের বেঙ্গালুরু এফসির স্বপ্ন ভেঙে আই লিগ জয় করেছিল মোহনবাগান। বেলো রেজ্জাকের একটা হেডার উদ্বেল করে দিয়েছিল কোটি কোটি মোহনবাগান সমর্থককে। কোচ সঞ্জয় সেনের সেই সাফল্যের ধারা অব্যাহত ছিল পরের মরশুমেও। সেবার আই লিগ জিততে না পারলেও সনি নর্দে, কাটসুমিরা সবুজ-মেরুন তাঁবুতে এনে দেন ফেড কাপ। আরও একবার দেশের সেরার খেতাব জিতে নেয় মোহনবাগান। কলকাতার আকাশ ছেয়ে যায় সবুজ-মেরুন আবীরে।
তার পর মাঝের কয়েকটা বছর ভালো যায়নি। ২০১৬-১৭ সালে অল্পের জন্য আই লিগ খেতাব হাতছাড়া হওয়া ছাড়া ২০১৯ পর্যন্ত সেভাবে সাফল্যের মুখ দেখেনি ক্লাব। তবে সবুজ-মেরুন সমর্থকরা বোধ হয় ২০১৬-১৭ মরশুম নিয়ে আজও আফসোস করেন। শেষদিন পর্যন্ত লিগজয়ের লড়াইয়ে ছিল মোহনবাগান। মাত্র দু পয়েন্টের জন্য সেবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায় আইজল এফসি।
মোহনবাগানের সাফল্য গাঁথার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ২০১৯ সালে। ততদিন পর্যন্ত টানা কলকাতা লিগ জিতছিল ইস্টবেঙ্গল। শঙ্করলাল চক্রবর্তীর মোহনবাগান ঘরোয়া লিগে লাল-হলুদের সেই দাপটের অবসান ঘটায়। ক্লাবের মাঠেই লিগের শেষ ম্যাচ সাক্ষী থেকে ছিল মোহনজনতার বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের। বিকেলের আবীর রঙা আকাশে সেদিন মিশেছিল সবুজ-মেরুন রং। পরের বছর কিবু ভিকুনার সেই অবিশ্বাস্য ছন্দময় মোহনবাগানের দ্বিতীয় আই লিগ জয়। পাসের ফুলঝুরি, জোসেবা বেইতিয়া-ফ্রান গঞ্জালেজদের প্রাণবন্ত ফুটবলে তখন গ্যালারি জুড়ে সবুজ-মেরুন হিল্লোল। শেষ ম্যাচে কল্যাণী কল্যাণময়। রাজ্যের শিল্পনগরী পুরোদস্তুর মোহনবাগান ডেরা। আই লিগ অভিযান মোহনবাগান শেষ করে চ্যাম্পিয়ন হয়েই।
পরের বছর কর্পোরেটের হাত ধরে আইএসএলে পদার্পণ। আশা-আশঙ্কার দোলাচল ছিল, ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল, তবে সবকিছু ছাপিয়ে ছিল সবুজ-মেরুন আবেগ। যে আবেগ পাথেয় করে আই লিগের সাফল্যের ধারা বজায় থাকল আইএসএলে এসেও। প্রথম মরশুমে অবশ্য চ্যাম্পিয়নশিপের খেতাব জোটেনি। কাপ জয়ের দোরগোড়া থেকে ফিরে আসতে হয়েছিল। সেই অধরা মাধুরী মোহনবাগান স্পর্শ করে ২০২৩-এ। ২০২৩-এর আইএসএলের শিরোপা জয়। অনেক চড়াইউতরাই পেরিয়ে সাফল্যের সেই সিংহদুয়ার স্পর্শ করেছিল সবুজ-মেরুন। গোয়ায় গ্যালারি হয়ে উঠেছিল সবুজ-মেরুন আবিরে অনাবিল।
এত কিছুর পরও একটা অপ্রাপ্তি থেকে গিয়েছিল। সেটা হল আইএসএলের লিগ শিল্ড। সেই অপ্রাপ্তির আফসোস মোহনবাগান মিটিয়ে দেয় গত মরশুমে লিগ শিল্ড জিতে। ডুরান্ড কাপ জিতে শুরুটা দুর্দান্ত হলেও আইএসএলের মাঝপথে হঠাৎ চোট আঘাত পেয়ে বসে সবুজ-মেরুনকে। প্রথমবার হারের হ্যাটট্রিকের মুখও দেখতে হয়। সেই ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে উঠে আসেন কোচ অ্যান্তনিও হাবাস। লিগ টেবিলের পাঁচে নেমে যাওয়া মোহনবাগান হঠাৎ যেন গতি ফিরে পায়। দেখতে দেখতে একমাত্র ট্রফি যা হাবাসের ক্যাবিনেটে ছিল না, সেই আইএসএল লিগ শিল্ডও চলে আসে মোহনবাগানের ঘরে। আর এ বছর লিগ শিল্ড জয় মোহনবাগানের শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি। মরশুমের শুরুটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হলেও মোলিনা বাহিনী একবার ছন্দে চলে আসার পর কার্যত অদম্য, অপরাজেয়র মতো খেলে গিয়েছে। আইএসএলের ইতিহাসে সর্বাধিক পয়েন্ট, সর্বাধিক জয় এবং সর্বাধিক ক্লিনশিট নিয়ে খেতাবজয় এই মুহূর্তে ভারতীয় ফুটবল সার্কিটে অন্য কোনও দলের পক্ষে অভাবনীয়।
সব মিলিয়ে গত ১০ বছরে মোহনবাগান দুটো আই লিগ, একটা ফেড কাপ, একটা ডুরান্ড, একটা আইএসএল ট্রফি, দুটো আইএসএল লিগ শিল্ড, একটা কলকাতা লিগ জিতেছে। দেশের আর কোনও ক্লাব এই সাফল্য দাবি করতে পারে কী? বেঙ্গালুরু এফসি, মুম্বই সিটি এফসির মতো কিছু ক্লাব হয়তো সাময়িক সাফল্য পেয়েছে। কিন্তু গত এক দশকে যে ধারাবাহিকতা মোহনবাগান দেখিয়েছে, সেটার ধারেকাছে কেউ নেই।