কৃষ্ণকুমার দাস, ঢাকা: ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় নির্বাচন। এই ভোট প্রক্রিয়াকে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ বলে অভিহিত করেছেন বিদেশি পর্যবেক্ষকরা। সোমবার ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিনিধিরা জানান, রবিবার তাঁরা বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন। নির্বাচন সফল, বৈধ ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে। এজন্য তাঁরা নির্বাচন কমিশন ও বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানান। বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিপন্ন এবং মানবাধিকার হননের অভিযোগে সরব হয়েছিল আমেরিকা ও পশ্চিমের দেশগুলো। কিন্তু সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে দরাজ সার্টিফিকেট দিলেন বিদেশি পর্যবেক্ষকরা।
এদিন সংবাদ সম্মেলনে আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, আয়ারল্যান্ড ও নরওয়ের নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা ভোটগ্রহণ বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতার কথা জানান। প্রায় ৪০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি সম্পর্কে একজন পর্যবেক্ষক বলেন, “বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সকাল ৮টে থেকে বিকাল ৪টে পর্যন্ত ভোটগ্রহণের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম।” তাঁরা আরও জানান, ভোটকেন্দ্রের কেউই তাঁদের কাছে কোনও অভিযোগ জানাননি। এই নির্বাচন গণতান্ত্রিক, জবাবদিহি এবং পেশাদারিত্বের সর্বোচ্চ মান পূরণ করেছে বলে তাঁরা মনে করেন।
নির্বাচনী প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করার বিষয়ে বিদেশি পর্যবেক্ষকরা জানিয়েছেন,”আমরা আমেরিকা-সহ সাতটি দেশের উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক, প্রাক্তন কংগ্রেসম্যান এবং সাংবাদিকদের একটি দল। আমরা বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছি। গতকাল, ৭ জানুয়ারি, ২০২৪, আমরা ৩ টি দলে বিভক্ত হয়ে ঢাকা ও আশেপাশের এলাকায় মোট ২০টি ভোট কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেছি। নাগরিক হিসাবে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রতিটি দেশের সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করবে এটাই প্রত্যাশিত। ভোটাধিকার প্রয়োগ করা একটি নাগরিক অধিকার। জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। একজন নাগরিকের নিরাপদ ভোটাধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তা দেওয়া সরকারের বিবেচনার উপর নির্ভর করে। আমরা ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে এসেছি এবং গতকাল পর্যন্ত আমরা দেখেছি বাংলাদেশের মানুষ তাঁদের ভোটাধিকারের ব্যাপারে খুবই আন্তরিক যা বিশ্বের অন্য দেশে খুব কমই পাওয়া যায়।”
[আরও পড়ুন: হাসিনার হাতে ফুলের তোড়া তুলে দিলেন ভারতের রাষ্ট্রদূত, দিল্লিকেই অগ্রাধিকার মুজিবকন্যার]
তাঁরা আরও বলেন, “বিশ্বের অনেক দেশ আছে যারা ভোট না দেওয়ার জন্য জরিমানা আরোপ করে এবং অনেক দেশ ভোটকে উৎসাহিত করার জন্য অতিরিক্ত নাগরিকত্ব সুবিধা দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ভোট দেওয়ার আগ্রহ ও উৎসাহ রয়েছে যা আমরা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক বলে মনে করি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ বাংলাদেশের নির্বাচনে খুবই আগ্রহী তারা বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী। সে কারণেই বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন প্রত্যাশা করে সবাই।”
এবারের নির্বাচন বয়কট করেছে বিএনপি-জামাত শিবির।
এই প্রসঙ্গে তাঁরা বলেন, “আমরা লক্ষ্য করেছি যে গতকাল সকাল ৮টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে বিকাল ৪টেয় শেষ হয়। আমরা যা দেখেছি তা হল বাংলাদেশের ভোট প্রক্রিয়া বিশ্বের অনেক দেশের মতোই। কিছু রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী প্রচারে অংশ না নেওয়া এবং একটি বড় রাজনৈতিক দলের ভোটে অংশগ্রহণ না করা নির্বাচনের উৎসবমুখর পরিবেশে কিছুটা প্রভাব ফেলেছে বলে মনে হয়। সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিলে পরিবেশ আরও সুন্দর ও আনন্দময় হতো। আমরা যে সব কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেছি সেখানে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে আমরা জানতে পেরেছি, ভোট দেওয়ার পথে তাঁদের কোনও বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থী বা দল দ্বারা ভোটারদের কোনও ভয়ভীতি দেখা যায়নি। এটা গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারের জন্য ভালো ইঙ্গিত। আমরা কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার কথা শুনেছি। সরকারি প্রার্থী, স্বতন্ত্র ও অন্যান্য দলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের মতো, যা অপ্রত্যাশিত। কিন্তু সার্বিক নির্বাচনী পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে সেসব ঘটনা খুবই নগণ্য।”
বলে রাখা ভালো, নির্বাচনে কারচুপি ও হিংসার অভিযোগে বিদ্ধ ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামি লিগ সরকার। বিরোধীদের ভয় দেখানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে লাগাতার। হাসিনা সরকারের উপর আর আস্থা নেই জানিয়ে এই সরকার ভেঙে তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচন করার দাবি জানিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু তা না হওয়ায় এইবারের ভোট বয়কট করে দেয় খালেদা জিয়ার দল। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ‘ডামি নির্বাচন’ বলেও তোপ দাগে বিএনপি। এই লক্ষ্যে গত কয়েক মাস ধরে বিক্ষোভ-অবরোধ জারি রেখেছে বিএনপি-জামাত-সহ সমমনা দলগুলো। ঘটেছে প্রাণহানি। বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল রাষ্ট্রসংঘ। এই নির্বাচন নিয়ে আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের রক্তচক্ষুর নজরে পড়েছিল বাংলাদেশ।
তবে এই নির্বাচনে ভোট দানের শতাংশ নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকছে। সকাল ৮টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার পর ঘণ্টা খানেক বিভিন্ন কেন্দ্রে সেভাবে ভোটার নজরে পড়েনি। দেশের বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে বেলা ১২.১০ মিনিট পর্যন্ত গড়ে সাড়ে ১৮ শতাংশ ভোট পড়েছিল। দুপুর ৩টে পর্যন্ত ভোটদানের হার ছিল ২৬.৩৭। এর মাঝখানে নরসিংদি-৪ আসনের একটি পোলিং বুথে জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল শিল্পমন্ত্রী নুরুল মাজিদ হুমায়ূনের ছেলে মঞ্জুরুল মজিদ ছেলের বিরুদ্ধে। এমনকী ১২টি ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেয় মজিদের দলবল। ওই কেন্দ্রের ভোট বাতিল করে দেয় কমিশন। এছাড়া চট্টগ্রাম-১০ আসনের খুলশির পাহাড়তলি ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে নৌকা ও ফুলকপি প্রতীকের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। এই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হন দুজন।